মন্ত্রিসভাকে ঘুমে রেখে মেডিকেল কলেজের সিদ্ধান্ত, সর্ষেতেই ভূত!
অনলাইন প্রতিনিধি :-কথায় আছে সর্ষেতেই যদি ভূত ঢুকে যায়, সেই ভূত তাড়াবে কে? এক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরা একই পথের পথিক।ফারাক শুধু বঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে তৃণমূল কংগ্রেস সরকার, আর ত্রিপুরায় ডা. মানিক সাহার নেতৃত্বে বিজেপির জোট সরকার।দুই রাজ্যে দুই পৃথক দলের সরকার হলেও, দুর্নীতির প্রশ্নে সকলেই এক। সম্প্রতি ত্রিপুরায় শান্তিনিকেতন নামে একটি বেসরকারী মেডিকেল কলেজ স্থাপন নিয়ে বিভিন্ন মহল থেকে যে অভিযোগ উঠেছে, তা ওই সর্ষেতে ভূত ঢুকে যাওয়ার মতোই ঘটনা বলে মনে করছে অনেকে।আর এই ঘটনার সাথে যেহেতু পশ্চিমবঙ্গেরও নাম জড়িয়ে রয়েছে,তাই বঙ্গেও বিষয়টি নিয়ে নানা জল্পনা শুরু হয়েছে।এই জল্পনার উৎস ও কারণ খুঁজতে গিয়ে পশ্চিমবঙ্গ এবং ত্রিপুরার বিভিন্ন মহল ও বিশ্বস্ত সূত্র থেকে যেসব তথ্য পাওয়া গেছে,তা অত্যন্ত ভয়ানক এবং উদ্বেগজনক।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ত্রিপুরা সরকারের প্রাক্তন স্বাস্থ্যসচিব ডি কে বাসু প্রথম বোলপুরের তৃণমূলনেতা অনুব্রত মণ্ডলের (বর্তমান জেলে বন্দি) স্বাধীন ট্রাস্টের সঙ্গে যোগাযোগ ও সখ্যতা গড়ে তুলেছিলেন।এই যোগাযোগটাও ছিল রহস্যময়।জানা গেছে, তৎকালীন স্বাস্থ্যসচিব ডি কে বাসু ওই সময়ে রাজ্য সরকারের কোনও অনুমোদন না নিয়েই,বলা যায় একপ্রকার নিজের উদ্যোগে স্বাধীন ট্রাস্টকে চিঠি দিয়ে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন ত্রিপুরা মেডিকেল কলেজ স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়ার জন্য।ওই সময়ে প্রাক্তন স্বাস্থ্যসচিব শ্রীবাসু এতটাই ক্ষমতাবান ছিলেন যে, স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে এড়িয়ে বকলমে তিনিই স্বাস্থ্য দপ্তর চালাতেন। হয়তো তার মনে হয়েছিল পরবর্তী কালে সবকিছু ম্যানেজ করে নিতে পারবেন এবং মুখ্যমন্ত্রীকেও রাজি করিয়ে নিতে পারবেন।ওই সময়ে নেওয়া তার একাধিক সিদ্ধান্ত ঘিরে যেমন জোর বিতর্ক হয়েছিল, তেমনি তার বিরুদ্ধে নানা দুর্নীতির অভিযোগও উঠেছিল।তা না হলে একজন স্বাস্থ্যসচিব কী করে সরকারের নজর এড়িয়ে
বহি:রাজ্যের একটি বিতর্কিত সংস্থাকে ত্রিপুরায় মেডিকেল কলেজ স্থাপনের উদ্যোগ নিতে চিঠি দিতে পারেন? যদিও বিষয়টি পরবর্তীকালে নজরে আসার পর মুখ্যমন্ত্রী ডা. মানিক সাহা সেই চিঠি বাতিল করে দিয়েছেন বলে খবর।এরপর বিষয়টি চুপচাপ হয়ে যায়।
তারপর গঙ্গা-গোমতী দিয়ে অনেক জল গড়িয়েছে।গরু পাচার সহ আরও একাধিক অভিযোগে অনুব্রত মণ্ডল সিবিআই এবং ইডির জালে আটকা পড়ে।অনুব্রতের প্রধান শাকরেদ মলয় পীঠ সহ আরও দুই-তিনজনকে সিবিআই, ইডি সমন পাঠিয়ে দফায় দফায় জিজ্ঞাসাবাদ করেছে।স্বাধীন ট্রাস্টের অন্যতম কর্ণধার মলয় পীঠের নাম শুধু গরু পাচারেই নয়, বঙ্গে শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতিতেও জড়িয়েছে।সেই
মলয় পীঠ পরবর্তীকালে ত্রিপুরায় মেডিকেল ব্যবসা প্রসারিত করার উদ্যোগ গ্রহণ করে।পশ্চিমবঙ্গের একাধিক মহল ও সূত্র থেকে জানা গেছে,প্রথমে যে করেই হোক ত্রিপুরা সরকারের সাথে সখ্যতা গড়ে তোলার প্রয়াস শুরু করেন মলয় পীঠ।তাতে
সফলও হন।জানা গেছে,এই সখ্যতা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সেতু হিসাবে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছেন বেশ কয়েকজন।তাদের মধ্যে রয়েছেন একজন জনপ্রতিনিধি, একজন চেয়ারম্যান, একজন একটি পত্রিকার মাথা, আরেকজন মহাকরণে বসে থাকা একজন প্রাক্তন আমলা।এমন আরও এক-দুইজন আছেন।এদের মাধ্যমেই সেতু বন্ধনের কাজ শুরু হয় অত্যন্ত গোপনে। অত্যন্ত গোপনেই পুরো এপিসোড নির্মাণ করা হয়েছে।আর এই সেতু বন্ধনে কোটি কোটি টাকার লেনদেনের গন্ধ পাওয়া গেছে।
এখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠেছে, যে চিঠি এবং উদ্যোগ প্রথমে মুখ্যমন্ত্রী বাতিল করে দিয়েছিলেন, পরবর্তীকালে কী এমন ঘটনা ঘটে গেল যে একেবারে ত্রিপুরা সরকারের কেবিনেটকে অন্ধকারে রেখে এতবড় সিদ্ধান্ত হয়ে গেল?কী এমন ঘটনা ঘটে গেল যে মুখ্যমন্ত্রী পরে রাজি হয়ে গেলেন?অভিযোগ, কেবিনেট সিদ্ধান্ত ছাড়াই আইজিএমের মতো রাজন্য স্মৃতিবিজড়িত, যার সঙ্গে রাণী ভিক্টোরিয়ার নাম এবং ত্রিপুরাবাসীর আবেগ জড়িয়ে রয়েছে, এমন ঐতিহ্যবাহী হাসপাতালকে একটি বেসরকারী এবং বিতর্কিত সংস্থার কাছে লিজ দিয়ে দেওয়া হয়েছে। মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত ছাড়া এটা হলো কীভাবে?খবর নিয়ে জানা গেছে, ত্রিপুরা সরকারের কেবিনেটে গত এক বছর ধরে শান্তিনিকেতন মেডিকেল কলেজ স্থাপন নিয়ে কোনও আলোচনা তো দূরের কথা, কেবিনেটের অ্যাজেন্ডাতেই এ বিষয় ছিল না।তাহলে কী করে এতবড় সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো?তাও পুরো কেবিনেটকে ঘুমে রেখে? এর পিছনে কী রহস্য রয়েছে? বঙ্গ ও ত্রিপুরার বিভিন্ন সূত্র থেকে যে তথ্য জানা গেছে, তাতে স্বাধীন ট্রাস্টকে দুই বছরের জন্য আইজিএম হাসপাতালটিকে লিজে দেওয়া হয়েছে।প্রশ্ন হচ্ছে, কোন্ শর্তে?কীসের ভিত্তিতে আইজিএম হাসপাতালকে লিজে দেওয়া হয়েছে? তা ত্রিপুরাবাসী জানতে চান। জানা গেছে, ন্যাশনাল মেডিকেল কমিশন ত্রিপুরায় ভিজিটে গেলে, এই আইজিএম হাসপাতালটিকে স্বাধীন ট্রাস্টের শান্তিনিকেতন মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের পরিকাঠামো হিসাবে দেখানো হবে। ডুকলিতে যে পরিকাঠামো নির্মাণ করা হচ্ছে,সেটা কমিশনকে দেখানো হবে না। কেননা, সেখানে এখনও অনেক পরিকাঠামো নির্মাণ হয়নি।আদৌ হবে কিনা?এর কোনও গ্যারান্টি নেই। স্বাভাবিকভাবেই কমিশনের ছাড়পত্র মিলবে না। তাই আইজিএম- কে স্বাধীন ট্রাস্টের মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল হিসাবে দেখানো হবে।আইজিএমে সবকিছুই আছে-পরিকাঠামো, ডাক্তার, রোগী, রোগীর শয্যা, বিভিন্ন
বিভাগ সবই রয়েছে। ফলে অনুমোদন পেতে সুবিধা হবে।
প্রশ্ন হচ্ছে, এত বড় একটি উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে,অথচ সরকারের কেবিনেট কিছুই জানবে না!কেবিনেট সিদ্ধান্ত ছাড়া ত্রিপুরায় মেডিকেল কলেজ স্থাপনের মতো বিশাল উদ্যোগ নেওয়া হলো কী করে?এর পেছনে কী রহস্য রয়েছে? আর এই ঘটনার সাথে বঙ্গের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর প্রসঙ্গও উত্থাপিত হয়েছে।ত্রিপুরার বিরোধী দলনেতা জিতেন্দ্র চৌধুরী মুখ্যমন্ত্রী ডা. মানিক সাহাকে লেখা চিঠিতে বঙ্গের বিরোধী নেতা শুভেন্দু অধিকারীর নাম উল্লেখ করে বলেছেন, বোলপুরের তৃণমূল নেতা অনুব্রত মণ্ডলের স্বাধীন ট্রাস্টের নানা অনিয়ম তুলে ধরে শুভেন্দুবাবু কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে চিঠি দিয়েছিলেন।সরকার যেন ভাবনাচিন্তা করে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়।এর জন্য জিতেন্দ্রবাবু মুখ্যমন্ত্রী ডা. মানিক সাহাকে চিঠিতে অনুরোধ করেছিলেন।এ ব্যাপারে আমরা বঙ্গের বিরোধী নেতা শুভেন্দু অধিকারীর বক্তব্য ও প্রতিক্রিয়া জানতে চেয়েছিলাম।আমরা শুভেন্দুবাবুর কাছে জানতে চেয়েছিলাম, বোলপুরে স্বাধীন ট্রাস্টের শান্তিনিকেতন মেডিকেল কলেজের নানা অনিয়ম নিয়ে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে অভিযোগ করে আপনি চিঠি দিয়েছিলেন, কিন্তু ত্রিপুরায় আপনাদের দলের সরকার সেই অনুব্রত মণ্ডল ও মলয় পীঠের স্বাধীন ট্রাস্টকে ডেকে নিয়ে মেডিকেল কলেজ স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে।এই বিষয়ে আপনি কী বলবেন?
এই প্রশ্নের জবাবে শুভেন্দুবাবু স্পষ্ট বলেন, ত্রিপুরা সরকার কী করছে সেটা আমি বলতে পারবো না।এ বিষয়ে আমার মন্তব্য করাটাও ঠিক হবে না। আমি এখানে বোলপুরে তাদের মেডিকেল কলেজের বিভিন্ন পরিকাঠামোগত ত্রুটি ও দুর্বলতা নিয়ে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলাম।বলেছিলাম, শাসকদলের ঘনিষ্ঠতার সুযোগ নিয়ে, ত্রুটি ও দুর্বলতা রেখেই তারা এসব করেছে। যদিও পরবর্তী কালে তারা সেসব ত্রুটিগুলি দূর করেছে এবং মেডিকেল কলেজের অনুমোদন পেয়েছে।তবে ত্রিপুরার বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারবো না। তবে ত্রিপুরার বিষয়ে শুভেন্দুবাবু কোনও মন্তব্য না করলেও, স্বাধীন ট্রাস্টের ত্রিপুরায় পদার্পণ নিয়ে কঠোর নজর থাকবে আমাদের।আমরা শেষ পর্যন্ত নজর রাখবো। ইতিমধ্যে আরও বেশকিছু তথ্য আমাদের হাতে এসেছে। ত্রিপুরাবাসীর স্বার্থে আমরা সব তথ্যই প্রকাশ করবো।