মানবতার সঙ্কট।।

 মানবতার সঙ্কট।।
এই খবর শেয়ার করুন (Share this news)

ইজরায়েলের গাজা ভূখন্ডে সবচেয়ে পুরনো একটি হাসপাতালের নাম আল আহলি আল আরাবি হাসপাতাল।১৪১ বছরের পুরনো এই হাসপাতালটি এই সময়ে গোটা মধ্যপ্রাচ্যের মধ্যে অন্যতম সবচেয়ে পুরনো একটি হাসপাতাল। হাসপাতালটির পাশেই আছে একটি গির্জা।প্রায় দেড়শ বছরের পুরনো একটি হাসপাতাল,যার পাশেই আছে গির্জা, যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজায় বিপন্ন বাস্তুচ্যুত মানুষদের কাছে এর চেয়ে নিরাপদ বিশ্বস্ত বেঁচে থাকার জন্য আর কোন আশ্রয় হতেই পারে না। এই কথা ভেবেই প্ৰাণ বাঁচানো নিরীহ মানুষ আশ্রয় নিয়েছিলেন হাসপাতালটিতে। ভেবেছিলেন, যুদ্ধবিধ্বস্ত অগণিত আহত যন্ত্রণায় ছটফট করা মানুষ যেহেতু এই হাসপাতালেই চিকিৎসা নিচ্ছেন, তাই এখানে অন্তত কিছু হবে না। কিন্তু হিংস্রতা, পৈশাচিকতা, উগ্রতা, আগ্রাসী উন্মাদনা মানুষকে কোন মানবিকতার কথাই শিক্ষা দেয়নি।প্রতিহিংসার আসুরিক প্রবৃত্তি মানুষকে এতটাই অন্ধ আর পিশাচ করে তোলে যেখানে মানবিকতা নামে কোন শব্দ থাকে না। ইজরায়েল- হামাস যুদ্ধে বুধবার মধ্যরাতে গাজার এই হাসপাতালে ধ্বংসলীলার ঘটনা সেই সত্যটাই আরও একবার সামনে টেনে এনেছে। এই ঘৃণ্য চরম নৃশংসতার ঘটনায় গোটা আন্তর্জাতিক মহলে সমালোচনার ঝড় বয়ে চলেছে।কিন্তু যারা এই আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন লঙ্ঘন করেছে তাদের বিরুদ্ধে শুধুই বিক্ষোভ আর সমালোচনাই কি শেষ কথা? যদিও ইজরায়েল জানিয়ে দিয়েছে হাসপাতালে হামলার ঘটনায় তারা জড়িত নয়, অন্য পক্ষ এই নৃশংসতা চালিয়েছে। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে মাত্র গতকালই মার্কিন রাষ্ট্রপতি বাইডেন ইজরায়েল পৌঁছান এবং বলেন হাসপাতালের বিস্ফোরণের ঘটনায় আমি মর্মাহত এবং আমি যা দেখেছি তাতে আমার মনে হয়েছে এটা ইজরায়েল নয়, অন্য কোন পক্ষ করেছে। হাসপাতালে হামলায় প্রাণ গেছে অন্তত শ’ ছয়েক মানুষের। কিন্তু যুদ্ধাপরাধের এই দায় কার, তা কিন্তু আরও জটিল এক প্রশ্নচিহ্ন সামনে এনে দাড় করিয়েছে।দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পৃথিবীতে জেনেভা কনভেনশনে যুদ্ধকালীন সময়ের নিয়ম সম্পর্কে স্পষ্টীকরণ দেওয়া আছে। এই কনভেনশনের ১৪ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী হাসপাতালকে নিরাপদ অঞ্চল হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে এবং ১৮ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যুদ্ধের সময় বেসামরিক হাসপাতালে এবং সেখানে কর্মরত ডাক্তার নার্স সহ সমস্ত স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষা সুনিশ্চিত করতে হবে। এর অর্থ হলো, কোন অবস্থাতেই যুদ্ধের সময় হাসপাতালে আক্রমণ বা হামলা করা যাবে না। যদি সে রকম কিছু করা হয় এবং বেসামরিক মানুষকে হত্যা করা হয় তা হলে জেনেভা চুক্তি লঙ্ঘন। শুধু জেনেভা কনভেনশনেই নয়, হেগ কনভেনশনেও যুদ্ধকালীন সময়ে আচরণ, শত্রুপক্ষের প্রতি ভূমিকা কী করা যাবে, কি নয়, কেমন আচরণ সম্ভব সবই স্পষ্ট করে উল্লেখ থাকা সত্ত্বেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে পৃথিবীতে একাধিক যুদ্ধ, মধ্যপ্রাচ্যের হামলা সংঘটিত এবং প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু জেনেভা কনভেনশন কিংবা হেগ কনভেনশনের কোন প্রস্তাব মান্য করা হয় নি।একই ঘটনা ঘটে গেছে ইরাকের মার্কিন ধ্বংসযজ্ঞের সময়েও।কিংবা আফগানিস্তানের যুদ্ধোন্মাদ তালিবান শাসকগোষ্ঠীর মদতেও।ব্যতিক্রম নয় রাশিয়া- ইউক্রেন যুদ্ধের ক্ষেত্রেও। দুর্ভাগ্যের ঘটনা হলো, উল্লেখিত ঘটনাগুলোতে প্রতিটি দেশই জেনেভা কনভেনশনের চুক্তিবদ্ধ দেশ হিসাবে স্বাক্ষরকারী হলেও তারা কনভেনশন অমান্য করে গেছে। আর এই ধরনের যুদ্ধ অপরাধ সংঘটিত করার অর্থই হচ্ছে যুদ্ধ অপরাধী হিসাবে সেই দেশকে আন্তর্জাতিক প্রথাগত আইনে দোষী সাব্যস্ত করে বিচার করা।সেই জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত যেমন রয়েছে, তেমনি যে কোন হাসপাতাল, কিংবা ঐতিহাসিক স্থাপনায় হামলার ক্ষেত্রে জেনেভা কনভেনশন লঙ্ঘনের দায়ে তার বিচারের দায়িত্বও আইসিসির উপর ন্যস্ত। কিন্তু বৃহৎ শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর প্রশ্নের যুদ্ধপরাধের তদন্ত শুরু করার কিংবা তাদেরকে আন্তর্জাতিক আদালতে শাস্তি দেওয়ার কোন নজির এ যাবৎ চোখে আসেনি। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য বহু ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক আদালতে অভিযোগ লিপিবদ্ধ হয়েছে। কিন্তু অভিযুক্তের শক্তি এবং তার প্রভাব বিচার করে অনেক ক্ষেত্রেই কোন অপরাধের উপযুক্ত বিচার হয়নি।আর মানবতাবিরোধী অভিযোগের ক্ষেত্রে অভিযুক্ত রাষ্ট্র যদি যুদ্ধে জয়ী হয়ে তাহলে তো সেই অভিযোগ প্রমাণ বা বিচারের প্রশ্নই আসে না।মোদ্দা কথা হল মানবতার বিরুদ্ধে এই ধরনের জঘন্য অপরাধের ঘটনা নতুন নয়। কিন্তু পশ্চিমা বিশ্ব বরাবরই এই ইস্যুতে নিরব থেকেছে। মানবতার বিরুদ্ধে এই নজিরবিহীন নৃশংসতার বিরুদ্ধে জাতি-ধর্ম-রাষ্ট্র নির্বিশেষে সকলকে সোচ্চার হতে হবে। অন্যথায় মধ্যপ্রাচ্যের এই সঙ্কট শুধু পশ্চিমা দেশগুলোর মধ্যেই নয়, গোটা মানবসভ্যতার জন্য বড়সড় বিপদ ও হুমকি ডেকে আনবে। জাতিসংঘ এবং পশ্চিমা বিশ্ব সহ বিশ্বের সমস্ত বৃহৎ মানবতাকামী রাষ্ট্র ও জাতির কাছে আহ্বান থাকবে অবিলম্বে এই বিপর্যয় মোকাবিলায় সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। মানবতাবিরোধী এই ধরনের অপরাধ থেকে সমস্ত শক্তিকে বিরত রাখতে হবে।

Dainik Digital

Dainik Digital

Leave a Reply

Your email address will not be published.