মানুষের শরীরে জায়গা পেল ছাগলের কার্টিলেজ

 মানুষের শরীরে জায়গা পেল ছাগলের কার্টিলেজ
এই খবর শেয়ার করুন (Share this news)

লম্বকর্ণ ! কোনও কালেই প্রশংসাসূচক নয় শব্দটি । লম্বকর্ণের সেই লম্বা কানই এখন প্লাস্টিক সার্জারির ক্ষেত্রে সহায় হয়ে প্রশংসা কুড়োচ্ছে বিজ্ঞানী মহলের । নেপথ্যে , খাস কলকাতার আরজিকর হাসপাতালের একটি গবেষণা । একজন দু’জন নয় ২৫ জনের দেহে জুড়ল ‘ লম্বকর্ণ ‘ । মানুষের শরীরে ছাগলের কার্টিলেজ ! অবাক লাগলেও এটাই সত্যি । পশ্চিমবঙ্গের ২৫ জনের নাক ও কানে এই কার্টিলেজ বসিয়ে চমকে দিয়েছেন একদল গবেষক – চিকিৎসক । ছাগলের কানে থাকা কার্টিলেজকে কোশমুক্ত করে , মানব শরীরে প্রতিস্থাপন করে , পেটেন্টেরও দাবি তুলেছেন প্রাণী ও মৎস্য বিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক ।

জন্ম থেকেই ডান কান গোটানো ছিল দক্ষিণ ২৪ পরগনার সন্দেশখালির সুমনের । ডাক্তারি পরিভাষায় যাকে বলে ‘ মাইক্রোশিয়া ‘ । ‘ ক্লেফট ঠোঁট নিয়ে । মানসিক অশান্তিতে ভুগছিলেন পূর্ব বর্ধমানের কালনার বারো বছরের অনিন্দিতা । চাঁদের মতো মুখে কাটা ঠোঁটই আজ অভিশাপ । সুমনকে আর মাফলারের আড়ালে কান লুকোতে হয় না । অনিন্দিতাকেও লুকোতে হয় না মুখ । প্লাস্টিক সার্জারি করে দু’জনের শরীরেই প্রতিস্থাপন করা হয়েছে ছাগলের কানে থাকা তরুণাস্থি । তাতেই শাপমোচন ।
প্রাণী ও মৎস্য বিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই গবেষক দলের সদস্য সমিতকুমার নন্দী এবং সিদ্ধার্থ জোয়ারদারের নেতৃত্বে এই অসাধ্যসাধন হয়েছে । তাদের দাবি , সুলভ দামে এবং সহজে এই কার্টিলেজ তৈরি করা যায় । তবে সেই লক্ষ্যে চ্যালেঞ্জও ছিল অনেক । যেমন , পশুর দেহ থেকে মানব শরীরে প্রতিস্থাপন সহজ নয় । সেই কোশ বহুক্ষেত্রেইমানব শরীরে খাপ খায় না । তাই অন্য পদ্ধতিতে এই গোটা প্রক্রিয়া সারতে হয় ।

রাজ্য প্রাণী ও মৎস্যবিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয় এবং আর জি কর মেডিক্যাল কলেজের সাত সদস্যের একদল চিকিৎসক – গবেষক ছাগলের কানের কার্টিলেজ বা তরুণাস্থি ব্যবহার করে তৈরি করে ফেলেছেন এই ‘ ইমপ্ল্যান্ট ‘ । এরই খোঁজ চলছিল দুনিয়াজুড়ে । এই ইমপ্ল্যান্ট জৈব পদ্ধতিতে তৈরি , দামও নামমাত্র । চার পাঁচ বছর ধরে চলা এই কাজের বর্ণনা প্রকাশিত হয়েছে ‘ জার্নাল অফ টিস্যু ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড রিজেনারেটিভ মেডিসিন ‘ – এ । শুধু তাই নয় প্রথমে খরগোশ ও কুকুরের উপর প্রয়োগ করে সন্তুষ্ট হন নি বিজ্ঞানীরা । তার পরেও সফল ভাবে ছাগলের কার্টিলেজের এই ইমপ্ল্যান্ট ব্যবহার করা হয়েছে ।
গবেষক দলের অন্যতম সদস্য তথা আর জি করের প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগের প্রধান রূপনারায়ণ ভট্টাচার্য বলেছেন , ‘ নাক – কান পুনর্গঠনের জন্য অস্ত্রোপচারের সংখ্যা প্রচুর । এই সব অপারেশনের ক্ষেত্রে রোগীর পাঁজর থেকে তরুণাস্থি নেওয়া অথবা বাজার থেকে রেডিমেড ইমপ্ল্যান্ট কিনতে হয় ।’ এক্ষেত্রে প্রথমে একটি অতিরিক্ত অপারেশন দরকার হয় , যা সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ায়।

তা ছাড়া সব রোগীর ক্ষেত্রে এই অপারেশন সম্ভবও হয় না । তাই অধিকাংশ ক্ষেত্রে ইমপ্ল্যান্ট কিনে নেওয়া হয় । কিন্তু তাতেও দু’টি সমস্যা রয়েছে । প্রথমত , ইমপ্ল্যান্টগুলি যেহেতু বিদেশি , তাই তার দাম ৮-১০ থেকে ৩০ হাজার টাকা প্রায় । আর দ্বিতীয়ত , সফল অস্ত্রোপচারের পরেও অনেক সময়েই ইমপ্ল্যান্টগুলি গ্রহণ করে না মানবশরীর ।
গবেষক দলের সদস্যদের দাবি , এই গবেষণা চিকিৎসা ক্ষেত্রে এক নতুন দিশা খুলে দেবে । একই সঙ্গে এই কার্টিলেজ ব্যবহার প্রযুক্তি যাতে সাধারণ মানুষের কাছেও পৌঁছায় , তার জন্য কর্পোরেট সংস্থার সঙ্গেও আলোচনা শুরু করবেন বলে জানিয়েছে তারা । প্রাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেটেরিনারি মাইক্রোবায়োলজির অধ্যাপক সিদ্ধার্থ জোয়ারদার বলেছেন , ‘ ছাগ কর্ণের যে তরুণাস্থি , তার মধ্যেকার কোশ অংশটিই প্রতিক্রিয়াশীল বলে রাসায়নিক পদ্ধতিতে সেই অংশটি নষ্ট করে দেওয়া হয় ।

তার আগে অবশ্য সেল কালচার করে মানবশরীরে তার গ্রহণযোগ্যতা যাচাই করে নেওয়া হয়েছিল । ‘ তিনি জানান , এই ইমপ্ল্যান্ট তৈরির আগে ছাগলের কানকে এমন ভাবে সংক্রমণমুক্ত করা হয় যে এ থেকে কোনও ঝুঁকির আশঙ্কা নেই ।
তরুণাস্থির বিকল্প নিয়ে অনেকদিন ধরেই চিন্তাভাবনা চলছিল । এতদিন প্লাস্টিক ও সিলিকনের ইমপ্লান্ট নিয়েই সীমাবদ্ধ ছিল গবেষণা । কিন্তু এই দু’টি বস্তুর কোনওটির সঙ্গেই মানবশরীর বেশিদিন মানিয়ে চলতে পারছিল না । তাছাড়া সিলিকনে সহজে সংক্রমণ ধরা পড়ছিল । দামও সাধারণের আয়ত্বের মধ্যে ছিল না । তাই গত প্রায় এক দশক ধরে হন্যে হয়ে তরুণাস্থির সুলভ , নমনীয় ও মজবুত বিকল্পের খোঁজ চলছিল ।

Dainik Digital

Dainik Digital

Leave a Reply

Your email address will not be published.