বিভৎস ট্রেন দুর্ঘটনা, ছিটকে গেল চলন্ত তিনটি মালগাড়ির কামরা!!
যে বার্তা জরুরি!!

দিন বাদেই আমাদের প্রজাতন্ত্র পঁচাত্তর পূর্ণ করে ছিয়াত্তরে পা দু দেবে। এক্ষণে অনেকেই হয়তো বিস্মৃত হয়েছেন যে, কাল অর্থাৎ শনিবার ২৫ তারিখ ভারতের নির্বাচন আয়োগ ৭৫ বর্ষে পা দেবে, উদযাপন করবে ‘অমৃত মহোৎসব’। পঁচাত্তর বছর আগে এই দিনেই যাত্রা শুরু করেছিল নির্বাচন কমিশন, সেই অর্থেই এ দিন জাতীয় ভোটার দিবস। ইংরেজি নতুন বছরের প্রথম ‘মন কি বাত’ – এর মঞ্চে নির্বাচন কমিশনের ভূয়সী প্রশংসা করে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, নির্বাচনি প্রক্রিয়াকে আরও আধুনিক করতে দীর্ঘ সময় ধরেই একের পর এক প্রযুক্তির ব্যবহার করেছে কমিশন, যা নিঃসন্দেহে প্রশংসাযোগ্য। এতে আমাদের ভোট প্রক্রিয়া আরও উন্নত হয়েছে। কমিশনকে দরাজ শংসাপত্র দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘জাতীয় ভোটার দিবস দিনটি এজন্য গুরুত্বপূর্ণ যে, সেদিন ভারতের নির্বাচন আয়োগ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সংবিধানের রচয়িতারা আমাদের নির্বাচন আয়োগকে, আমাদের গণতন্ত্রে জনগণের অংশীদারিত্বকে অনেক বড় স্থানে রেখেছেন। . আমিও নির্বাচন আয়োগকে ধন্যবাদ জানাব। তারা সময় সময়ে আমাদের ভোটদানের প্রক্রিয়াকে আধুনিক করে তুলেছেন, শক্তিশালী করে তুলেছেন।’তর্কাতীতবে মুখ্য নির্বাচন কমিশনারই ভারতের শীর্ষ আমলার পদ। ভারতের প্রতিটি জাতীয় নির্বাচনই মহারাজসূয় যজ্ঞ, বিশ্বের মধ্যে জনসংখ্যার দিক দিয়ে বৃহত্তম, জনসমাজের বহুত্ব ও বিচিত্রতার পরিপ্রেক্ষিতে কঠিনতম। তবে লক্ষণীয়, গত বছর সেই কঠিন কাজটির মধ্যে পদে পদে পরাজয়ের নিশানা পরিলক্ষিত হয়েছে। কথাটা এই জন্যই আসছে কারণ গত লোকসভা নির্বাচন থেকে পরবর্তী সময়ে হরিয়ানা ও মহারাষ্ট্র বিধানসভা নির্বাচনের ভোটগ্রহণ কেন্দ্র করে নিরপেক্ষতা নিয়ে যত বিতর্ক এবং সেই সূত্রে সর্বোচ্চ আদালতে মামলা দায়ের হয়েছে, তা বেনজির। সেই ১৯৫১-৫২ সালে প্রথম নির্বাচন কমিশনার সুকুমার সেনের তত্ত্বাবধানের সময় থেকে দৃষ্টান্তমূলক যত্নসহকারে যে কাজ হয়ে আসছে, সেই পরিপ্রেক্ষিতেই চব্বিশে আঠারোতম জাতীয় নির্বাচনটিতে বিস্তর অস্বস্তি ও হতাশার কারণ ঘটেছে। বিরোধীরা অভিযোগ তুলেছেন, ভারতীয় গণতন্ত্র তার অসামান্য যাত্রাপথে পিছু হাঁটতে শুরু করেছে- নির্বাচন কমিশনের এ বারের আচরণেই তার স্পষ্ট ইঙ্গিত। অনেকগুলি ক্ষেত্রে কমিশনের বিবেচনা নিয়ে, নিরপেক্ষতা নিয়ে সন্দেহ তৈরি হয়েছে। সেই সব সন্দেহের উত্তর যা-ই হোক, তা যে তৈরি হওয়ার অবকাশ ঘটল, সেটাই অতীব দুর্ভাগ্যজনক। ১৯৫১ সালের ‘রিপ্রেজেন্টেশন অব দ্য পিপল অ্যাক্ট’ অনুযায়ী, ভোটদান পর্বের ৪৮ ঘণ্টা আগে ‘সাইলেন্স পিরিয়ড’ বা নীরবতার পর্ব সব প্রার্থীরাই তা মেনে চলেন, প্রচারের সমাপ্তি ঘোষণা করেন। কিন্তু চব্বিশের লোকসভা নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী ঠিক সেই ৪৮ ঘণ্টাকেই বেছে নিয়েছিলেন কন্যাকুমারীতে ধ্যানমণ্ডপম-এ ধ্যানে বসার জন্য এবং সারা দেশের সমস্ত প্রচারমাধ্যম তা প্রতি মুহূর্তে জনসাধারণের কাছে পৌঁছে দিয়েছিল। ব্যক্তিগত ধ্যান আর জনসমক্ষে ক্যামেরাপরিবৃত ধ্যান এক কথা নয়; দ্বিতীয়টি যদি প্রচারমাধ্যমে দেখানো হয়, আক্ষরিক অর্থেই তা ‘প্রচার’। বিরোধীরা এ ব্যাপারে অভিযোগ জানালেও কমিশন তাতে কর্ণপাত করেনি। বিরোধী নেতারা তার আগে প্রধানমন্ত্রী ও তার অন্যান্য দলের নেতার মুখে সরাসরি সাম্প্রদায়িক প্রচারের বিরুদ্ধেও কমিশনের কাছে পদক্ষেপের আপিল জানিয়েছিলেন, তাতেও ফল হয়নি। সরাসরি বিদ্বেষ প্রচারের ক্ষেত্রেও কমিশন ভ্রূক্ষেপ করেনি বলে অভিযোগ। অথচ রাজনৈতিক প্রচারে তর্কবিতর্ক যেমন গণতন্ত্রের অধিকার, তেমনই যে কোনও সম্প্রদায়েরও স্বাধীনতা প্রাপ্য, প্রাপ্য আক্রান্তবোধ না করার স্বাধীনতা। নির্বাচন কমিশন সেই অধিকার ও স্বাধীনতাদানেও কার্যত ব্যর্থ। জমিবাড়ি নয়, টাকাপয়সা নয়, সাধারণ জনতার অধিকারের নয়ছয়ের অভিযোগে আন্দোলিত হয়েছে সমাজ, যা কদাচ অভিপ্রেত নয়। ২০২৩ সালের শেষে মধ্যপ্রদেশ ও ছত্তিশগড় এবং ২০২৪ সালে মহারাষ্ট্র ও হরিয়ানায় নির্বাচনের ফল বিপুল বিস্ময়ের জন্ম দিয়েছে। এই চার রাজ্যের নির্বাচনি হেঁয়ালির কিনারা আজও কোনও শার্লস হোমস্, ব্যোমকেশ বক্সি, ফেলু মিত্ররা করে উঠতে পারেননি। লোকসভা নির্বাচনের মাস কয়েকের মধ্যে ভোটার চরিত্র কীভাবে এমন ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে যেতে পারে, সেই ব্যাখ্যাও কারও কাছে নেই। মাত্র পাঁচ মাসে ভোটারের হৃদয় বদলের এমন নজিরও সাম্প্রতিককালে দেখা যায়নি। পরাজিতরা যেমন বিহ্বল ও হতচকিত, জয়ীরাও তেমনই হতবাক। শেষপর্যন্ত ভোটের ফলাফল যা-ই হোক না কেন, এ দেশের ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রের পরিবেশটি বাঁচানোর দায়িত্ব যে সব প্রতিষ্ঠানকে বহন করতে হবে, নির্বাচন কমিশন তার মধ্যে অন্যতম প্রধান। কমিশনের কাজ, ৭৫তম বর্ষে এই জরুরি বার্তাটি নাগরিক মনে প্রোথিত করা।