রক্তাক্ত শৈশব!!

 রক্তাক্ত শৈশব!!
এই খবর শেয়ার করুন (Share this news)

গত অক্টোবর থেকে মার্চ, ছয় মাস ধরে উত্তপ্ত পশ্চিম এশিয়া।ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রনীতির প্রধান জোসেক বোরেল ফিলিস্তিনিদের একমাত্র ভূখণ্ড গাজাকে বিশ্বের বৃহত্তম উন্মুক্ত কবরস্থান আখ্যা দিয়েছেন।ইজরায়েলের সঙ্গে অসম যুদ্ধে নিহতের সংখ্যা বত্রিশ হাজার ছুঁই ছুঁই। গুরুতর জখমের সংখ্যা প্রায় চুয়াত্তর হাজার।যুদ্ধের জেরে গৃহহীন মানুষের সংখ্যা অন্তত বাইশ লক্ষ।ইজরায়েলি বোমায় অসংখ্য মানুষের বসতভিটে ধ্বংসস্তূপে পর্যবসিত।যুদ্ধবিরতির উপরেই নির্ভর করছে শত সহস্র সাধারণ মানুষের প্রাণ। এই অবস্থায় সবচেয়ে মর্মান্তিক অবস্থা শিশুদের। ইউনিসেফের তথ্য বলছে,১৩ হাজারের বেশি শিশু গাজায় ইতিমধ্যে নিহত হয়েছে।উত্তর গাজায় দুই বছরের কম বয়সি প্রতি তিনজনের একজন শিশু তীব্র অপুষ্টির শিকার।তীব্র খাদ্যসঙ্কটে উত্তর গাজার মানুষ।সেখানে কার্যত দুর্ভিক্ষের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।অথচ আক্ষেপের বিষয়,গাজায় রক্তাক্ত শৈশবের মর্মন্তুদ দৃশ্যাবলি দেখেও আন্তর্জাতিক নাগরিক মহল সেভাবে এখনও সোচ্চার নয়।গাজার শিশুরা খালি পেটে দিন কাটাচ্ছে। রাষ্ট্রপুঞ্জ জানিয়েছে,মারাত্মক অপুষ্টিতে ভুগছে শিশুরা। যদিও দ্য জেনিভা কনভেনশন এবং শিশু অধিকার রক্ষায় রাষ্ট্রপুঞ্জের কনভেনশন অনুযায়ী, স্কুল, হাসপাতাল, শরণার্থী শিবিরে কোনও অজুহাতেই হামলা চালানো যায় না।কিন্তু তাতে কী?দেখা যাচ্ছে যুদ্ধের আইন বা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার রক্ষার আইন লঙ্ঘনে কী সন্ত্রাসবাদী,কী তাদের দমনকারী রাষ্ট্র,সকলের ভূমিকাই সমান,কোনও প্রভেদ
নেই।শুধু গাজা কেন, রাষ্ট্রপুঞ্জের হিসাবে, সুদানে গোষ্ঠীসংঘর্ষে প্রতি ঘন্টায় সাতজন শিশু নিহত বা আহত হচ্ছে।ইউনিসেফ-এর মতে, সংঘর্ষদীর্ণ আফগানিস্তান, ইয়েমেন, সিরিয়া, ইরাক, মালি, নাইজিরিয়া, সোমালিয়া, সাউথ সুদান, সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক ও ডেমোক্র্যাটিক গণপ্রজাতন্ত্রী কঙ্গোর মতো বিশ্বের অন্তত ১০টি দেশ কয়েক দশক ধরে শিশুহত্যায় রক্তস্নাত।যদিও আজ আর কোনও সহিংস মৃত্যুর খবর, সে শিশুর হোক,সে মৃত্যুর সংখ্যা মাত্র কয়েক দিনেই হাজার ছাড়িয়ে যাক- আমাদের তেমন আর স্পর্শ করে না।

রক্তাক্ত শৈশব শুধু গাঁজায় নয়, ব্রিটেন-ভিত্তিক প্রখ্যাত অসরকারী সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেন-এর রিপোর্ট বলছে, ২০১৩ থেকে ২০১৭-র মধ্যে বিশ্বজুড়ে এক বছরের কম বয়সি সাড়ে ৫ লক্ষাধিক শিশুর মৃত্যু হয়েছে ভয়ঙ্কর সংঘর্ষের অভিঘাতে।আজ পৃথিবীর প্রায় ৪২ কোটি শিশু সশস্ত্র সংঘাতে বিপর্যস্ত এলাকায় বাস করতে বাধ্য হচ্ছে।যুদ্ধের নামে গাজায় যা চলছে, প্রকৃত অর্থে তা গণহত্যা।রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের অন্তরালে এক্ষণে জরুরি প্রশ্নটি হলো,বীভৎস ধ্বংসের মধ্যে থেকে যে শিশুরা কোনওক্রমে বেঁচে ফিরছে,তারা নিয়ত যেভাবে তাদের বাবা মা ভাই বোন বন্ধুদের মৃত্যু প্রত্যক্ষ করছে, শিশুমন সেই অমানুষিক দুঃখ ও যন্ত্রণার ধাক্কা কতদূর সইতে পারবে? এই উন্মত্ত হিংসার পৃথিবীতে যে কয়েক লক্ষ শিশু শেষ পর্যন্ত যদি বাঁচার সুযোগ পেয়েও যায়, তা হলেও কি তারা কোনওদিন পুরোপুরি সুস্থ স্বাভাবিক জীবনের নাগাল পাবে?সময় কি তাদের সংঘর্ষের আতঙ্ক ও বিষাদ স্মৃতি মুছিয়ে দিতে পারবে?
পশ্চিমি দুনিয়া চিরকালই আরব-ইজরায়েল সংঘর্ষে ইজরায়েলের পক্ষে।পশ্চিমের প্রতিবাদী বামপন্থীরাও এর ব্যতিক্রম নন। ফিলিস্তিনি দার্শনিক এডওয়ার্ড সাইদ আরব-প্যালেস্টাইনের দুর্দশার প্রতি সিমোন দ্য বোভোয়ার বা জঁ পল সার্তের মতো ফরাসি বামপন্থী চিন্তকদের উদাসীনতায় ক্ষুব্ধ হয়ে একদা প্রশ্ন তুলেছিলেন,যারা ভিয়েতনাম মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সরব, তারা প্যালেস্টাইন মুক্তিযুদ্ধের বিষয়ে নিশ্চুপ
কেন?যেখানেই যত যুদ্ধ বা সংঘর্ষ, তার মূলে আছে অর্থনীতির দখলদারি, ফ্যাসিবাদ।বিবেকহীন শাসকদের লাগাতার এই সংঘর্ষে শুধু শিশুর মৃত্যু নয়, যারা বেঁচে থাকে তাদের মনের উপর ভয়ঙ্কর প্রভাব পড়ে। তথ্য বলছে, গাজায় প্রতি পাঁচজন শিশুর মধ্যে চার জনই আতঙ্কিত,মানসিক বিপর্যয়ে বিধ্বস্ত। মা-বাবা হারানো শিশুদের সংখ্যাও সংখ্যাতীত। লক্ষ লক্ষ শিশুর এভাবে বাঁচার অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে।এর প্রতিবাদে আমরা আজও পথে নামিনি, কারণ আমরা শঙ্কিত নই। তথাকথিত সভ্যদের কাছে বিপন্ন শৈশব, রক্তাক্ত শৈশবের মতো চরম অমানবিক শব্দবন্ধও ক্রমে সহনীয় হয়ে উঠছে।বিবেকের দংশনকে ধামাচাপা দিতে চাইছে তথাকথিত সভ্য সমাজ। আদপে কিন্তু ধামাচাপা দিতে চাইছে নিজেদের মনুষ্যত্বকে।

Dainik Digital

Dainik Digital

Leave a Reply

Your email address will not be published.