রবির কিরণে উদ্ভাসিত নারী

 রবির কিরণে উদ্ভাসিত নারী
এই খবর শেয়ার করুন (Share this news)

‘ছোটো প্রাণ, ছোটো ব্যথা । ছোটো ছোটো দুঃখকথা, নিতান্ত সহজ সরল ।…… অন্তরে অতৃপ্তি রবে, সাঙ্ করি মনে হবে শেষ হইয়াও হইলো না শেষ’ – ছোটো গল্পের এত সুন্দর সংজ্ঞা ও ব্যাখ্যা  একমাত্র রবীন্দ্রনাথই দিতে পারেন। শৈশবে মায়ের পুরানো সেই দিনের কথায় কিংবা ছোটো নদীর বাঁকে বাঁকে তাঁর সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় । কৈশোরে নিরুপমা, ফটিক বা চন্দরা মনের গহীনে স্থান করে নেয় – করে তোলে স্বাভিমানী। মধ্যযুগ থেকে শুরু হয়ে যায় নারীকে পদানত করে পর্দানসীন রাখার অদম্য প্রয়াস। সতীদাহ, সহমরণ,  বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ তথা একাদশী উপবাসের মত নানা শৃঙ্খলের বেড়াজালে নারী ভুলতে থাকে স্বীয় অস্তিত্ব । যন্ত্রবৎ চালিত হয়  রক্ত মাংসের মানবী।  যার ভয়াবহ রূপ ঊনবিংশ শতকের সমাজসংস্কারকদেরকে ব্যথিত করে তোলে – এগিয়ে আসেন নারী জীবনের হৃত সম্মান পুনরুদ্ধারে। রবীন্দ্রনাথ তাদেরই অন্যতম একজন। তাঁর ক্ষুরধার লেখনীর মাধ্যমে নারীকে রক্তমাংসের মানবীতে পরিনত হতে শক্তি সঞ্চার করে  – একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় । সেই সময়কার সমাজজীবনের নানাবিধ ঘটনা ছোটো ছোটো গল্পাকারে রচনার মাধ্যমে কাল-আজ-পরশুর জন্য তৈরি করে গেছেন মনোবল- সঞ্চার করেছেন শক্তি ও সাহস।  

রবীন্দ্রনাথ ১১৯ টি ছোটো গল্প লিখেছেন,যার মাধ্যমে তদানীন্তন  সমাজজীবনের বিভিন্ন প্রেক্ষাপট তুলে ধরে জনজীবনকে সচেতন করতে চেয়েছেন । বাংলাভাষায় ছোটোগল্পের সূচনা হয় আমেরিকার পদাঙ্ক অনুসরণ করে । সেই প্রাথমিক যুগে বিদেশি সাহিত্যের সাহায্য গ্রহণ না করে উপায় ছিল না । বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গল্প – রচয়িতা প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় এ সম্পর্কে আলোচনা করে বাংলা ছোটগল্পে রবীন্দ্রনাথের অসাধারণ কৃতিত্বের কথা স্মরণ করেছেন । তিনি লিখেছেন , “ উপন্যাসের মত , ছোটগল্প জিনিসটাকেও আমরা পশ্চিম হইতে বঙ্গসাহিত্যে আমদানি করিয়াছি । ছোটগল্পের জন্ম সুদূর পশ্চিম আমেরিকায় । মার্কিনেরা বড় ব্যস্ত জাতি — তাহাদের নিশ্বাস ফেলিবার অবকাশ নাই— তাই বোধ হয় সে দেশে ছোটগল্পের জন্ম হইয়াছিল আমেরিকা হইতে ইউরোপে এবং তথা হইতে আনীত হইয়া এখন ইহা মহিয়সী বঙ্গবাণীর চরণে নৃপুরস্বরূপ বিরাজিত , মৃদু মধুশিজ্ঞনরবে বঙ্গীয় পাঠকের চিত্ত বিনোদন করিতেছে । পূর্বকালে বঙ্গদর্শনে বঙ্কিমবাবু তিনটি ছোটগল্প লিখিয়াছিলেন । সঞ্জীববাবু দুই একটি লিখিয়াছিলেন বলিয়া স্মরণ হইতেছে । কিন্তু সেগুলি আকারে ছোটমাত্র , নচেৎ উপন্যাসেরই লক্ষণাক্রান্ত । বর্তমান সময়ে ছোটগল্পের মধ্যে যে একটা নিজস্ব বিশেষত্ব আছে , তাহা সেগুলিতে ছিল না । ছোটগল্প বলিতে আমরা যাহা বুঝি , শ্রীযুক্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাশয়ই তাহা বঙ্গসাহিত্যে প্রথম প্রবর্তন করিয়াছিলেন । ” অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলা সাহিত্যের ছোটগল্প যে অধিকতর কাব্যধর্মী ও ব্যঞ্জনাপ্রধান , তার কারণ সম্ভবত রবীন্দ্রনাথের বিশেষ কল্পনাদৃষ্টির প্রভাব ।

 গল্প আর ছোটো গল্প যে ভিন্নধারা তা সুচারুভাবে প্রতিফলিত হয়েছে তাঁর রচনায় । তাঁর রচিত প্রথম সার্থক ছোটো গল্প হলো ‘ঘাটের কথা’। রবীন্দ্রনাথের  মুন্সিয়ানা হচ্ছে তিনি তৎকালীন সমাজের ঘটনাপ্রবাহ বিশেষত নারীদের অবস্থান কতটা শোচনীয় ছিল তা খুব সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন ছোটো গল্পে । তৎকালীন সমাজে নববধূর প্রতি সমাজ তথা পরিবারের দৃষ্টিভঙ্গি বা আচরণ কেমন ছিল তা খুব সুন্দরভাবে চিত্রিত হয়েছে তার ছোটো গল্পে । এ প্রসঙ্গে যে নামটি আগে আসে সেটি হলো হৈমন্তী । রূপবতী ও গুণী হওয়া সত্বেও শুধুমাত্র তার বাবা তার বিপুল ঐশ্বর্য হৈমন্তীকে দেননি বলে শ্বশুরবাড়ির লোকজনদের অনাদর অবহেলায় অকালে ঝরে যেতে হয়েছে তাকে । পরবর্তীতে আমরা নিরুপমাকেও একইভাবে হারিয়ে যেতে দেখতে পাই। উভয় ক্ষেত্রেই তাদের স্বামী সবকিছু বুঝলেও প্রতিবাদ করার সাহস দেখাতে পারেনি। তবে নিরুপমা পণের টাকা ফেরৎ পাঠিয়ে নীরবে প্রতিবাদ জানায়। বলতে দ্বিধা নেই যে, এই একবিংশ শতকেও সেই দৃষ্টিভঙ্গির খুব একটা পরিবর্তন ঘটেনি। আজও প্রতিদিন বহু নারীকে পনের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করতে হয় বা হত্যা করা হয়। আবার, চন্দরাকেও আমরা রবির কিরণে স্বাভিমানীরূপে পাই। ছিদাম যখন বলল ‘বৌ মরলে বৌ পাইবো, ভাই মরলে পাইবো কোথায়? ‘ ছিদাম যখন বড়ভাই-এর অপরাধ নিজের বৌ চন্দরার কাঁধে চাপিয়ে দেয় নির্দ্বিধায় এবং সাথে এইধরনের উক্তি করে তখনই সুন্দরী ষোড়শী গ্রাম্যবধূ চন্দরা অভিমানে ক্ষোভে আদালতে নিজে খুন না করেও সেই খুনের দায়ভার নিয়ে আদালতের শাস্তি মাথা পেতে নেয়। এর মাধ্যমে সে একদিকে যেমন আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠা করে অন্য দিকে তেমনি নারীও যে রক্ত মাংসে গড়া একজন মানুষ এবং সেও সম্মানের অধিকারী – সেই চরম সত্যিটুকুও বোঝাতে চেয়েছে। ‘রামায়ণের সেই ধারা আজও সমানে চলছে’-র মতো এই চিত্র আজও ততটাই ভাস্বর – পরিশীলিত হয়েছে মাত্র।

শুধু তাই নয়, পরাধীন ভারতে স্বাদেশিকতায় উদ্বুদ্ধ হয়ে বদনাম-এর ভাগিদার হতেও দেখা যায় সৌদামিনিকে। মোট কথা, নদীপথে ঘুরতে ঘুরতে পল্লীজীবনের নানা ঘটনা লেখককে উদ্বুদ্ধ করেছে। তিনি নিজেই লিখেছেন, ” একসময়  ঘুরে বেড়িয়েছি বাংলার নদীতে নদীতে, দেখেছি বাংলার পল্লীর বিচিত্র জীবনধারা । একটি মেয়ে নৌকো করে শ্বশুরবাড়ি চলে গেল, তার বন্ধুরা নাইতে নাইতে বলাবলি করতে লাগল,  আহা যে পাগলাটে মেয়ে,  শ্বশুরবাড়ি গিয়ে তার কি জানি কি দশা হয় । কিংবা ধর , এক খ্যাপাটে ছেলে যে দুষ্টুমির চোটে সারা গ্রামে মাতিয়ে বেড়ায়, তাকে একদিন হঠাৎ চলে যেতে হলো তার মামার বাড়ি । এটুকুই দেখেছি, বাকিটা নিয়েছি কল্পনা করে” (সাহিত্য,  গান ও ছবি : প্রবাসী -১৩৪৮ সন)। এখানে ‘সমাপ্তি’ ও ‘ছুটি’ গল্প দুটির প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে তা বলাই বাহুল্য । দূর হতে বস্তুজীবনের রহস্যময় ঘটনাকে বাস্তবে পরিণত করার সফল রূপকার হলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর । এ প্রসঙ্গে আমাদের রাজ্যের রাজপরিবারের কাহিনী অবলম্বনে ‘রাজর্ষি’ উপন্যাস বা ‘বিসর্জন’ ও ‘মুকুট’ নাটকের প্রসঙ্গ উত্থাপন করতেই পারি । রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে শুধুমাত্র ছোট গল্পের মাধ্যমেই নারীকে আত্মপ্রত্যয়ী ও প্রতিবাদী করতে চেয়েছেন তাই নয়, তার বিভিন্ন উপন্যাস বা কবিতার মাধ্যমেও নারীকে প্রতিবাদ মুখর হয়ে আত্মমর্যাদায় উদ্ভাসিত করতে সচেষ্ট ছিলেন। কেননা, প্রতিটি মানুষকেই স্বীয় মর্যাদার লড়াইটা নিজেকেই লড়তে হয়। তাই এই একবিংশ শতকেও রবিঠাকুর ও তার রচনা ততটাই প্রাসঙ্গিক।
—– অর্পা রায় চৌধুরী

Dainik Digital

Dainik Digital

Leave a Reply

Your email address will not be published.