রাজধর্মের আহ্বান!!

 রাজধর্মের আহ্বান!!
এই খবর শেয়ার করুন (Share this news)

তৃতীয় দফায় প্রধানমন্ত্রী পদে শপথগ্রহণের ঠিক পরের দিনই সরসংঘচালক মোহন ভাগবত নরেন্দ্র মোদিকে সেই বার্তা দিয়েছেন,যা বাইশ বছর আগে গুজরাটে জাতিহিংসার পরে তদানীন্তন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রীকে দিয়েছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী। বার্তাটি, রাজধর্ম পালনের। সংঘপ্রধান বিজেপি দলের আজন্ম অভিভাবকপ্রতিম। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ এ দলের বৌদ্ধিক চর্চার প্রাণকেন্দ্র।সুতরাং,শপথের অব্যবহিত পরেই সংঘপ্রধানের বার্তাটি সবিশেষ প্রণিধানযোগ্য বললে অত্যুক্তি হবে না।
সোমবার নাগপুরে সংঘের সদর দপ্তরে আরএসএসের শিক্ষানবিশদের একটি সভায় ভাগবত অন্তত তাৎপর্যপূর্ণভাবে বলেছেন, ‘প্রকৃত সেবকের অহংকারী হওয়া সাজে না।তাকে মর্যাদা রক্ষা করে চলতে হয়।কিন্তু, নির্বাচনি প্রচারে সেই মর্যাদা রক্ষিত হয়নি।’তিনি বলেছেন, ‘যিনি বাস্তবিকই সেবক,যাকে প্রকৃত অর্থেই সেবক বলা যায়,তিনি সর্বদা মর্যাদা রক্ষা করে চলেন।যিনি সেই মর্যাদা পালন করে চলতে পারেন, তিনিই কর্মবীর।তবে তাকে কাজের মোহগ্রস্ত হলে চলবে না।কাজ করার পর যেন তার অহংকার জাগরুক না হয়। যেন না বলেন,আমিই এই কাজ করেছি।অহংকার যাকে গ্রাস করে না, তিনিই প্রকৃত সেবক।’সেই সঙ্গে ভাগবত স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন সেই অমোঘ বার্তা,যেটি এ দেশের সমাজ চিন্তকদের মনের কথা- ভারতের মতো বিশাল বৈচিত্র্যপূর্ণ দেশে সহমতের ভিত্তিতে চলাই বিধেয়। ভাগবত আরও বলেছেন, ‘বিরোধীদের গুরুত্ব দিতে হবে।প্রতিপক্ষ নয়,প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে দেখতে হবে তাদের’। বিজেপি একক ভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারানোর পর সরসংঘচালকের মন্তব্যের উদ্দিষ্ট যে নরেন্দ্র মোদি, সেটি বুঝতে রাজনৈতিক তাত্ত্বিক হওয়া নিষ্প্রয়োজন।ভাগবত খানিক টিপ্পনী কেটে বলেছেন,’এ ভাবে কেমন করে দেশ চলবে,ভাই।সবাই মিলে দেশকে চালাতে হবে তো!দুটি পক্ষ রয়েছে।একটি পক্ষকে বিরোধী পক্ষ বলা হয়।আমি অবশ্য তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী বলি। তারা বিরোধী নন,তেমনটা ভাবাও উচিত নয়।তারা প্রতিদ্বন্দ্বী, অন্য ভাবনাকে তুলে ধরেন।তাদের কথাকে গুরুত্ব দিতে হবে।সংঘপ্রধানের মতে, ‘ভোট হলো সর্বসম্মতি তৈরির একটি প্রক্রিয়া।সংসদে দুইটি দিক রয়েছে, যেখানে কোনও প্রশ্নকে দুইটি দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যেতে পারে।একটি দল একটি দিককে তুলে ধরলে বিরোধীদের উচিত অন্য দিকটি তুলে ধরা।তা হলেই সঠিক পথে এগোনো সম্ভব।’ এমনকী, মণিপুরে হিংসার বাতাবরণ শেষ করার গুরুত্ব কেন্দ্রকেই দিতে হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
ভাগবত যে এত কথা বলেছেন তার নির্যাস সরল।সেটি হলো, দেশের সেবক তিনিই যিনি রাজধর্ম পালন করেন। রাজধর্ম কী?সহজ কথায়,
দেশের সর্বস্তরের জনগণকে সমদৃষ্টিতে দেখা।যেখানে ‘আপন’ ও ‘অপরে’পার্থক্য নিরূপণ করা হয় না, হলেও অন্তত তা প্রকটভাবে নয়। ‘সেবক’যখন নিজেকে ঈশ্বরপ্রেরিত দূত হিসাবে তুলে ধরেন এবং ঈশ্বরের ইচ্ছা পুরণ করার জন্য ধর্মভীরু জনগণের কাছে ভোট চান, এই অভাবনীয় দৃশ্যকল্প আজকের নির্মম বাস্তব হতে পারে, তবে তা কখনওই প্রজাহিতকর নয়।ভাগবতের বক্তব্যের সারাৎসার বিনির্মাণ করলে বোঝা যাবে, এই নির্বাচনের ফলাফল দেখে তিনি সম্যকভাবে উপলব্ধি করেছেন, শুধু হিন্দুরাষ্ট্রের সাধনায় ভারত নামক ধারণাটির আত্মাকে পাল্টে দেওয়া সহজ কাজ নয়। নির্বাচনের আগে ‘সিএসডিএস-লোকমত’-এর একটি সমীক্ষাতেও সেই তথ্যটি উঠে এসেছিল।তবে সমীক্ষার দরকার নেই,ধর্মীয় উস্কানি যে পেটের ভাতের পরিপূরক হতে পারে না, এই কথাটি মানুষ নিজের যাপিত অভিজ্ঞতায় বুঝছেন, আজকের ভোটের ফলাফল তারই ইঙ্গিত।এই ফল বহু মানুষের অপছন্দ হতেই পারে, কিন্তু ভারতীয় গণতন্ত্র যে এই সূত্রে রুখে দাঁড়ানোর জায়গা ও সময় পেয়েছে এতে কোনও সন্দেহ নেই।সুবিধাভোগী উচ্চবিত্ত অংশের অনেকের জন্য গণতন্ত্র হয়তো একটি অলঙ্কারের চেয়ে বেশি কিছু নয়,কিন্তু ব্যাপক অংশের জনগণের জন্য গণতন্ত্রের খোলা হাওয়া কার্যত বেঁচে থাকার অক্সিজেন।অনুমান করা চলে, দেশের মানুষ বুঝেছেন যে, খালি পেটে ধর্ম হয় না- বেঁচে থাকতে হলে ধর্মের আগে অন্ন প্রয়োজন। ইতিহাস বলে, দীর্ঘদিন ধরে মানুষকে বোকা বানানো চলে না। ভারতের মাটিতে দিনের শেষে স্বয়ং সংঘপ্রধান যে শাসককে এ কথাটি স্মরণ করিয়ে দিলেন, এটাই আনন্দের।

Dainik Digital

Dainik Digital

Leave a Reply

Your email address will not be published.