রাজনীতির কুনাট্য!!

এই খবর শেয়ার করুন (Share this news)

পাকিস্তানি সন্ত্রাসবাদীদের নৃশংস হত্যালীলায় ছাব্বিশ জন নিরীহ পর্যটকদের নিহত হওয়ার শোকই মুখ্য অনুভূতি হওয়ার কথা ছিল।কিন্তু,তার পরিবর্তে সমাজের একটা বড় অংশের মধ্যে ঘৃণার গরল উপচে পড়ছে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য এটাই যে, মঙ্গলবার রাত থেকে পরবর্তী আটচল্লিশ ঘন্টায় শাসক দলের এক শ্রেণীর নেতার আচরণে,বয়ানে শুধু ধর্মীয় বিভাজন আর বিদ্বেষের গরল নিঃসৃত হয়ে চলেছে। রাজনীতির চালচিত্রের এমন বিকৃত চেহারা দেখলে শুভবুদ্ধিসম্পন্ন নাগরিক সমাজকে আরও বেশি করে গ্রাস করে অজানা আতঙ্ক।
পহেলগাঁওয়ের জঙ্গি হামলায় নিহতদের মধ্যে তিনজন পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দা। দুইজন কলকাতার।বুধবার রাতেই তাদের মরদেহ কলকাতা বিমানবন্দরে এসে পৌঁছায়। তারপর থেকেই মৃত্যু এবং অশান্তিকে ঘিরে এক টানটান রাজনৈতিক প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়েছে সে রাজ্যের শাসক তৃণমূল ও বিরোধী দল বিজেপি।কলকাতার দুই নিহতের মধ্যে একজন বিতান চৌধুরীর বৈষ্ণবঘাটার বাড়িতে বৃহস্পতিবার দলীয় বিধায়ক অগ্নিমিত্রা পালকে সঙ্গে নিয়ে সমবেদনা জানাতে যান বিজেপি নেতা শুভেন্দু অধিকারী।সে সংক্রান্ত একটি সংক্ষিপ্ত ভিডিও ক্লিপ সমাজ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে।তাতে দেখা যাচ্ছে, নিহতের চার বছরের শিশুপুত্রকে কোলে নিয়ে শুভেন্দু কান্নায় ভেঙে পড়া নিহতের স্ত্রীকে বলছেন, ‘আপনি এখানে সবাইকে বলুন যে, আপনি হিন্দু, হিন্দু বলে আপনার স্বামীকে মেরেছে’।এই ভাষায়, এই আচরণ সমবেদনার, সংহতির? আগামী বছর বঙ্গে বিধানসভা নির্বাচন।বিজেপি জয়ী হলে শুভেন্দু অন্যতম মুখ্যমন্ত্রী-পদপ্রার্থী।তবে ভোটের জন্য রাজনীতিকে এতখানি নিচে নামানো,এতটা অবনমন এ দেশ আগে দেখেনি।নিহতের বাড়ি থেকে বেরিয়ে সংবাদ মাধ্যমের সামনে শুভেন্দু বলেন, ‘পহেলগাঁওতে হিন্দু নিধন হয়েছে। ভারতীয় হিন্দু বলেই খুন করা হয়েছে। বাংলার হিন্দু পর্যটকদের অনুরোধ করব, যেখানে হিন্দু সংখ্যা বেশি, সেখান যান, কারণ জীবনের মূল্য অনেক’। পরে সংযোজন করেন, ‘যারা মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় যাবেন, কলমার একটা লাইন প্র্যাক্টিস করে যেতে হবে’।
এটা ঠিকই যে জঙ্গিরা ধর্মীয় পরিচয় জেনে হত্যালীলা চালিয়েছে। সেটাই তাদের উদ্দেশ্য ছিল। চক্রান্ত ছিল, একটা বিধ্বংসী নাশকতা ঘটিয়ে তারপর এত বড় দেশটার মধ্যে বিভাজনের আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া। এটাই পাকিস্তানের বরাবরের ষড়যন্ত্র, ভারতে অরাজকতা সৃষ্টি করা।
আমাদের সকলের কর্তব্য, জঙ্গিদের এবং পাকিস্তানের সেই চক্রান্ত অর্থ করা, তাদের চক্রান্তের ফাঁদে পা না দেওয়া। অথচ শাসক দলের নেতাদের একটি ছোট অংশে গত আটচল্লিশ ঘন্টায় অবারণ বিদ্বেষের বল বর্ষিত হয়েছে। ঘটনাচক্রে, ঘটনার দিন দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বিদেশ সফরে ছিলেন।কিন্তু সেই সফর কাটছাঁট করে বুধবার ভোরে তড়িঘড়ি তিনি দেশে ফেরেন।ঘটনাচক্রে,বিরোধী দলনেতা রাহুল গান্ধীও আমেরিকায় ছিলেন এবং তিনিও দেশে ফিরেছেন।এদিন শাসক দলের কর্ণাটক প্রদেশের এক্স হ্যান্ডেলে রাহুলের একটি সাদা-কালো ছবি দিয়ে উপরে ইংরেজিতে লেখা হয়, ‘রাহুল গান্ধী যতবার দেশের বাইরে যান, ততবারই ফিরে আসেন দেশের অশুভ সময়ে’। এটা রাজনীতি পরিভাষা নয়, বরং দুর্যোগের মধ্যে সুযোগসন্ধানের খোঁজ।
ঘটনার গতিপ্রকৃতি দেখে অনুমান হচ্ছে, পহেলগাঁওয়ের ঘটনা ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীকে নিজেদের মধ্যে যুদ্ধে জড়িয়ে দিতে পারে। বকলমে যে যুদ্ধ শেষপর্যন্ত গিয়ে দাঁড়াবে চিন বনাম ভারতের।পহেলগাঁওয়ে যা ঘটেছে তা দুর্ভাগ্যজনক, নিন্দার যে কোনও ভাষাই এখানে তুচ্ছ।কিন্তু তারপর থেকে দেশের মধ্যে যেভাবে পারস্পরিক ধর্মীয় হিংসা উস্কে দেওয়া হচ্ছে, দুর্ভাগ্যজনক ভাবে শাসক দলের একশ্রেণীর নেতা উস্কে দিচ্ছেন,সেটি অবিলম্বে বন্ধ হওয়া দরকার।১৯৯৯ সালের ২৬ জুলাই পাক সেনাকে ধরাশায়ী করে কার্গিলের কঠিন যুদ্ধে বিজয়ী হয়েছিল ভারতীয় সেনা। প্রধানমন্ত্রীর কুর্সিতে তখন অটলবিহারী বাজপেয়ী। এমন কোনও ভাষ্য রাষ্ট্রযন্ত্রের কোনও অংশ থেকে ছড়িয়ে দেওয়া হয়নি এবং ধারণা নির্মাণও করা হয়নি যে, একটি বিশেষ ধর্মকে সবক শেখাল ভারত। ‘ভারতরত্ন’ অটলবিহারী ২০০২ সালে গুজরাটে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ঘটনার নিন্দা করে বলেছিলেন, ‘গুজরাটের ঘটনা দেশের কলঙ্ক’। এটাই দৃষ্টান্তমূলক রাজধর্ম।
এই হঠকারী হত্যালীলার বিরুদ্ধে কাশ্মীরের সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ, তাদের জীবন-জীবিকার উপর হঠাৎ নেমে আসা ঘোর অনিশ্চয়তা, উগ্র সাম্প্রদায়িক চিল-চিৎকারে হারিয়ে যাচ্ছে। মানবজাতি শ্রেষ্ঠ কারণ তার মধ্যে অজস্র সূক্ষ্ম বোধ নিহিত থাকে, কিন্তু এই ঘৃণাভাষ্যে, রাজনীতির কুনাট্য মানুষকে হিংসাত্মক দীক্ষায় তাতিয়ে রাখতে চাইছে। তবে দেশের সৌভাগ্য আজও সাধারণ মানুষের একটা বড় অংশ মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন, দেশে কোনও সংঘর্ষ, কোনও সন্ত্রাসবাদী হামলায় শিখ, হিন্দু, মুসলিমরা নিহত হয়নি, নিহত হয়েছে মানুষ। আর মানুষের সঙ্গে প্রতিটি সংঘর্ষে, প্রতিটি সন্ত্রাসে দেশও মরেছে ক্ষতবিক্ষত হয়ে।

Dainik Digital

Share
Published by
Dainik Digital

Recent Posts

জি-৭ সম্মেলনে যোগদান করতে মোদীকে আমন্ত্রণ দিলেন কানাডার প্রধানমন্ত্রী!!

অনলাইন প্রতিনিধি :- ভারত ও কানাডার মধ্যে টানাপড়েনের সম্পর্কে কানাডা প্রধানমন্ত্রী মোদিকে জি ৭ সম্মেলনে…

9 hours ago

শুক্রবার বিশ্বের সর্বোচ্চ রেলসেতু চেনাব চন্দ্রভাগা ব্রিজের উদ্বোধন করলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী!!

অনলাইন প্রতিনিধি :-শুক্রবার জম্মু-কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লা, রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণবের সঙ্গে রেলসেতু ঘুরে দেখেন প্রধানমন্ত্রী।…

17 hours ago

হরিয়ানায় শপিংমলে গুলি!!

অনলাইন প্রতিনিধি :-হরিয়ানার পঞ্চকুলার একটি মলের সামনে অজ্ঞাত পরিচয়ধারী কয়েকজন দুষ্কৃতি পরপর কয়েক রাউন্ড চালায়…

17 hours ago

দঃজেলার ৫০%র বেশি গ্রাহকই বিদ্যুতের বিল জমা দেন নাঃ মন্ত্রী!!

অনলাইন প্রতিনিধি :-রাজ্যে বিদ্যুৎ পরিষেবা গ্রহণকারী বিদ্যুৎ গ্রাহকদের বিল পেমেন্টের বেহাল অবস্থার কথা তুলে ধরলেন…

18 hours ago

বিমানে বিস্ফোরক বহন!

অনলাইন প্রতিনিধি :- সম্প্রতি দিল্লি, হায়দরাবাদ, চেন্নাই এবং বেঙ্গালুরু বিমানবন্দর সারপ্রাইজ ভিজিট’ করেন ভারতের অসামরিক…

18 hours ago

অমীমাংসিত ঘটনায় সিস্টারের কারখানায় তালা দিলো শিল্প নিগম!!

অনলাইন প্রতিনিধি :-বাধারঘাট শিল্প তালুকে সিস্টার গুঁড়া মশলার একটি কারখানা ঘরে তালা ঝুলিয়ে দিলো টিআইডিসি।…

20 hours ago