রাজনীতির টোপ!!
নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় তার বিখ্যাত ‘টোপ’ গল্পে প্রতাপদন্তী এক অভিজাত পুরুষের দানবিক নির্মমতার রূঢ় স্বরূপটিকে ধরতে চেয়েছিলেন।সামন্ততান্ত্রিক সেই জমিদার পুরুষটি বাঘ শিকারের জন্য এক হিংস্রতম আয়োজন সাজান।শিকারের জন্য ছাগশিশু নয়,একটি জীবন্ত মানবশিশুকে শিকারের টোপ হিসাবে ব্যবহার করেন।ওই নিষ্ঠুর ঘটনা আদৌ সত্য নাকি লেখকের কল্পনাপ্রতিভা, আমাদের জানা নেই।তবে টোপ যে সর্বদা নিষ্ঠুর হয়, এমন কখনোই নয়।বিশেষত রাজনৈতিক টোপ তো কদাচ নয়।বরং সেই টোপের মধ্যে দাতা ও গ্রহীতার মধ্যে পারস্পরিক চাওয়া-পাওয়া বিষয় নিহিত থাকে।
রাজনীতিতে অবশ্য ‘টোপ’ কথাটি ব্যবহৃত হয় না,বলা হয় ‘দর কষাকষি’বা প্রকারভেদে ‘কৌশল’।রাজ্যে তেরো বছর,কেন্দ্রে দশ, মোট তেইশ বছরের দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় মোদি এই প্রথম জোট সরকারের প্রধান হিসাবে শপথ নেওয়ার স্বাদ পেয়েছেন।ছুঁয়েছেন কাঙ্খিত নেহরুর রেকর্ড।নিন্দুকেরা বলতে পারেন,’ইস বার,দর কষাকষির সরকার’। বিশেষত, নীতীশ কুমার এবং চন্দ্রবাবু নাইডুর মতো পরিপক্ক জোটসঙ্গীর মোকাবিলা করে শরিকি সরকার চালানোর পথে কত কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হবে, সেই চিন্তা হয়তো এখন প্রধানমন্ত্রীর নিত্যসঙ্গী।আপাতত বাহাত্তর সদস্যের মন্ত্রিসভায় এগারোটি আসন পেয়েছে শরিক দলগুলি, ৩১ জন পূর্ণমন্ত্রীর মধ্যে তাদের সদস্য পাঁচজন। অর্থাৎ, সংখ্যার বিচারে বিজেপি নি:সংশয়ে প্রধান। সুস্পষ্ট তাদের প্রাবল্য ও প্রাধান্য। পূর্ণমন্ত্রীর আসনে বিজেপির আধিপত্য জানান দেয়,গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রকগুলি প্রধানত তাদেরই হাতে। মোদির তৃতীয় মন্ত্রিসভা মোটের উপর যেন পূর্ববর্তী সরকারেরই সম্প্রসারিত চিত্রবলি।তবে এ বকুল বিছানো পথে খোলা চোখে ‘কাঁটা’ যদি কিছু লুক্কায়িত থাকে, তবে সেটি একটি নয়, দু’টি।চন্দ্রবাবু নাইডু এবং নীতীশ কুমার।এই নেতাদ্বয় তাদের রাজনৈতিক জীবনে এমন অনেক জোটের খেলায় দক্ষ শিল্পীর পরিচয় দিয়েছেন।জোটের ট্র্যাপিজে কীভাবে খেলতে হয়, এরা বিলক্ষণ জানেন।দরাদরিতে বরাবর সিদ্ধহস্ত চন্দ্রবাবু। নীতীশও অনুরূপ।সামান্য সংখ্যক বিধায়ক/সাংসদ নিয়ে ডিগবাজি খেয়ে কী করে ক্ষমতার সঙ্গে ভিড়ে থাকতে হয়, নীতীশ সেই খেলার মহাগুরু।অবোধ জনতা তাকে ‘পাল্টুরাম’ অভিধায় ভূষিত করতে পারে, তাতে কী এসে যায়! চন্দ্রবাবুর চেয়ে সংখ্যায় সামান্য খাটো (চন্দ্রের যোলো, নীতীশের বারোজন সাংসদ) হলেও প্রথমে তিনিও হেঁকে বসেছিলেন কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ক্যাবিনেট পদ। চন্দ্রবাবু চেয়েছিলেন স্পিকারের পদ, কিন্তু পাননি। তবু এই ধুরন্ধর নেতাদ্বয় নমনীয় হলেন কোন যাদুমন্ত্রে? এর উত্তর হতে পারে ‘রাজনৈতিক টোপ’। স্পিকার বা কেন্দ্রে একাধিক মন্ত্রকের বদলে অন্ধ্রের জন্য মোটা অঙ্কের আর্থিক সাহায্য এবং আগামী বছর বিহার বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি-জেডিইউ জোট ক্ষমতায় এলে নীতীশকে মুখ্যমন্ত্রীর আশ্বাস।চন্দ্রবাবু এবং নীতীশ, দুজনেরই মূল লক্ষ্য নিজ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর কুর্সি। মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তাদের রাজ্যের উন্নয়নের জন্য তহবিল বেশি প্রয়োজন, এমনটা এই নেতাদ্বয়কে বোঝানোটাই সহজ।সম্ভবত এই দ্বৈত কৌশল তথা টোপেই এনডিএ সরকারের দুই প্রধান এবং ঘোড়েল শরিক তেলুগু দেশম পার্টি ও জেডিইউকে একটি করে পূর্ণমন্ত্রীর পদ ও তিনটি ‘কম গুরুত্বের’ মন্ত্রক দিয়েই সন্তুষ্ট রেখেছে বিজেপি।
কল্পনার পোলাওয়ে ঘি ঢেলে ‘ইন্ডিয়া’ জোটের কুশীলবেরা যদি ভেবে থাকেন যে, তৃতীয় মোদি সরকার বেশিদিন টিকবে না,তবে তারা দিবাস্বপ্ন দেখছেন।এনসিপির প্রফুল্ল প্যাটেল কিংবা একনাথ শিন্ডের মধ্যে পূর্ণমন্ত্রীর পদ চেয়ে ঈষৎ বেসুরো চলন দেখা গেলেও এই সরকারের অস্বস্তির কোনও হেতু আছে বলে মনে হয় না।কারণ, মোদি সরকারের থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে নিলে বিজেপি তাদের দলে ভাঙন ধরাতে পারে বলে চন্দ্রবাবু, নীতীশদের মনে ভয় আছে। হয়তো সেই কারণেই এই নেতাদ্বয় লোকসভার স্পিকারের পদের জন্য আগ্রহী ছিলেন, যাতে তারা সমর্থন প্রত্যাহার করলেও বিজেপি তাদের সাংসদদের ভাঙিয়ে নিতে না পারে।সেক্ষেত্রে স্পিকার দলত্যাগী সাংসদদের সদস্যপদ খারিজ করে দেবেন।
বুধবার মোদির উপস্থিতিতে অন্ধ্রের মুখ্যমন্ত্রী পদে শপথ নিয়েছেন চন্দ্রবাবু।তিনি অন্ধ্রপ্রদেশের রাজধানী হিসেবে অমরাবতীর উন্নয়নের কাজ নতুন করে শুরু করতে চান।তার জন্য ৪০ হাজার কোটি টাকা প্রয়োজন।এই অর্থ সাহায্যের বার্তাও দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।কোন্ দেবতা কোন্ ফুলে সন্তুষ্ট হন, তা অধুনা ভারতীয় রাজনীতিতে নরেন্দ্র মোদির চেয়ে ভালো কেউ জানেন কি?