রাতদুপুরে সরগরম

 রাতদুপুরে সরগরম
এই খবর শেয়ার করুন (Share this news)

বাড়িটি দূর থেকে চোখ টানে । সাদা ধবধবে দোতলা বাড়ি । নজরকাড়া ফুলবাগান । শান্ত পরিবেশ । তবে মাঝে – মাঝে বাড়ির দণ্ডমুণ্ডের কর্ত্রী সৌদামিনী দেবীর হইচই শোনা যায় এর জন্য দায়ী গৃহকর্তা বিক্রম সেন সৌদামিনী দেবীর ভাইয়ের ছেলে । বিক্রম সেন যৌবনে প্রেমে পড়েছিলেন পাশের বাড়ির ফুটফুটে নিকিতার পরিণয় দূর অস্ত , মুখ ফুটে প্রেম নিবেদনের সাহস হয়নি তার । দুর্ঘটনার ভয়ে বাড়ির অ্যাম্বাস্যাডর গাড়ির স্টিয়ারিং ছুঁয়ে দেখেননি কখনও । নৌকা ভ্রমণ হয়ে উঠেনি এই জীবনে , কারণ , যদি জলে ডুবে যান , এ ভয়ে সাঁতার শেখেননি তিনি । এমনটা জানলে ঠাকুরদা সূর্যপ্রতাপ সেন তার নাম বিক্রম রাখতেন না ।

বাড়িতে দু’টি মাত্র প্রাণী এখন । বহু বছরের চাকর দাশু দিনকয়েক আগে গ্রামের বাড়ি গেছে । বিক্রমবাবুর উপস্থিতি টেরই পাওয়া যায় না , কারণ , পিসিমা সৌদামিনী দেবীর ভয়ে তটস্থ হয়ে থাকেন তিনি সর্বদা । পিসিমা বাংলায় এমএ । বনশ্রী গার্লস হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা ছিলেন । বিয়ে – থা করেননি । বিক্রমবাবুর বাবাকে বলেছিলেন , মাতৃভাষায় শিক্ষাই প্রকৃত শিক্ষা । সেজন্য বাংলা ভাষা আত্মস্থ করতে হবে । বিক্রমের ভার আমার উপর ছেড়ে দে । বিক্রমবাবুকে বাংলায় বিশারদ বানাতে পিসিমার উঠে পড়ে লাগাটাই হয়তো কাল হয়ে দাঁড়াল সমোচ্চারিত শব্দ শেখানোর মাঝপথে হাত ছেড়ে দিলেন সৌদামিনী দেবী । বিক্রম দেশ ও দ্বেষের পার্থক্য জানে না ।

তাকে অবিরাম ও অভিরাম কিংবা নিরাশ ও নিরাসের পার্থক্য শেখাতে গিয়ে গলদঘর্ম হয়ে পড়লেন পিসিমা । পিসিমার হাতে কানমলা , গাঁট্টা খেতে – খেতে বিক্রমের সাহস কর্পূরের মতো উবে গেল । বড় হয়েও সেই ভয় আর কাটিয়ে উঠতে পারেননি তিনি । পিসিমার কোনও কথাও মনে রাখতে পারেন না তিনি । এ নিয়ে পিসিমা তুলকালাম কাণ্ড ঘটাবেন , আর পাড়া – প্রতিবেশীরা বিক্রমকে ভয়ে সিঁটিয়ে থাকতে দেখবেন , এমনটাই হয়ে আসছে । পিসিমার আর কী দোষ ! সেদিন সৌদামিনী দেবী বিক্রমবাবুকে মুসুরডাল আনতে বললেন । রাস্তা দিয়ে যেতে – যেতে মুসুর হারিয়ে শুধু ডাল মগজে ডালপালা মেলতে শুরু করল ।

মাথা চুলকে বিক্রমবাবু জগদীশবাবুর বাড়ি থেকে হাসনুহানার ডাল নিয়ে ফিরলেন । বাড়িতে আজ ধুমধাম করে লক্ষ্মী পুজো হচ্ছে । অনেকদিন পর বাড়ি আজ জমজমাট । একে একে আত্মীয় – স্বজন আসছেন । পাড়া প্রতিবেশীরা সন্ধ্যায় আসবেন । সৌদামিনী দেবী দিন দুয়েক আগে আবারও প্রতিজ্ঞা করেছেন আর যাই হোক বিক্রমকে কিছু আনতে বলবেন না । তারপর যথারীতি প্রতিজ্ঞা ভুলে আজ সকালে খুব নরম সুরে বলেছেন , বিক্রম দরজার জন্য দুটো সাদা পর্দা আনিস তো বাবা । পিসিমার কথা যাতে না ভুলে যায় তাই সারা রাস্তা পর্দা – পর্দা জপতে জপতে গেলেও দোকানের সামনে গিয়ে তালগোল পাকিয়ে শেষ পর্যন্ত বাজার থেকে জর্দা ও সাদাপাতা কিনে ফিরলেন বিক্রমবাবু ।

পিসিমা আত্মীয় পরিজনদের কথা ভেবে দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করলেন । সৌদামিনী দেবীর গত কয়েকটা । দিন ধরে খুব ধকল যাচ্ছে । কিন্তু হাজার ক্লান্তি সত্ত্বেও আজকাল তার ভাল ঘুম হয় না । একটা কোলবালিশ পাশে থাকলে ভাল ঘুম হবে কিনা কে জানে ! কিন্তু কে এনে দেবে তার কোলবালিশ ? বিক্রমবাবু সকাল থেকে ব্যাজার মুখে এদিক – ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছেন । সন্ধ্যায় ঠাকুরঘরে বসে কয়েকবার ঢুলুনির পর পিসিমা বাধ্য হয়ে বললেন , সকালে যা হবার হয়েছে । বাবা বিক্রম , এবার একটা কোলবালিশ কিনে আনিস ।

দেখিস ভুল করিস না যেন । বাড়ি আজ গমগমে । এখন বিক্রমবাবুর মনও ফুরফুরে । পিসিমার আদেশ পালন করেছেন তিনি । মাঝরাতে সব কাজ সেরে পিসিমা বললেন , বিক্রম এবার আমি ঘুমাব । নিয়ে আয় । দুলকি চালে পিসিমার ঘরে ঢুকলেন বিক্রমবাবু । হাত বাড়িয়ে দিতেই সৌদামিনী দেবী আর্তনাদ করে উঠলেন , এটা কী রে হতভাগা ? আমি কোলবালিশ আনতে বললাম , আর তুই নেলপালিশ নিয়ে এলি । রাতদুপুরে পিসিমার হইচইয়ে সরগরম হয়ে উঠল পাড়া ।

———-পারিজাত দত্ত

Dainik Digital

Dainik Digital

Leave a Reply

Your email address will not be published.