এই খবর শেয়ার করুন (Share this news)

পশ্চিমবঙ্গ তো বটেই, বস্তুত গোটা দেশ-কাঁপানো একটি ধর্ষণ- খুনের ঘটনায় ১৬৫ দিনের মাথায় চূড়ান্ত রায় ঘোষণা করেছেন কলকাতার জেলা দায়রা বিচারক। মূল অভিযুক্ত, ঘটনায় একমাত্র ধৃত ব্যক্তিকে যাবজ্জীবন (আমৃত্যু) কারাবাসের দণ্ড দিয়েছে আদালত। কিন্তু আদালতের রায়ে স্পষ্টতই হতাশ নাগরিক সমাজ। বৃহত্তর অংশের মনের প্রশ্ন, সরকারী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ভিতরে মধ্যরাতে কর্তব্যরত একজন মহিলা চিকিৎসককে কি কখনও একজনের পক্ষে নারকীয় নির্যাতন করে খুন করা সম্ভব? এমনকী দোষীর সাজা কেন মৃত্যুদণ্ড হলো না, কেন ফৌজদারি অপরাধের তদন্তের প্রশ্নে দেশের সর্বোচ্চ তদন্তকারী সংস্থা এমন নিষ্ঠুরতম একটি অপরাধকে ‘বিরলের মধ্যে বিরলতম’ হিসাবে প্রতিপন্ন করতে পারল না-ইত্যাকার নানা প্রশ্ন সমাজের বড় অংশের মনের গভীরে ঘুরপাক খাচ্ছে।
আরজিকর কাণ্ডে চিকিৎসক পড়ুয়া ধর্ষণ- খুনের পরে নাগরিক সমাজের ভিতর থেকে ক্ষোভের যে উদ্‌দ্গীরণ শেষ পর্যন্ত দেখা গেছে, তার ভরকেন্দ্র শুধুমাত্র একটি হত্যাকাণ্ড কিংবা একত্রিশ বছরের একজন কর্তব্যরত চিকিৎসকের হত্যাকাণ্ড নয়, বরং এই জনবিক্ষোভে ফেটে বেরিয়ে এসেছিল পুলিশ ও প্রশাসনের বিরুদ্ধে সমাজের চাপা অসন্তোষ। কিন্তু তাই যদি হয়, প্রশাসন তথা সরকারের বিরুদ্ধে মানুষের যদি এতই অসন্তোষ থেকে থাকে, তবে আরজি কর কাণ্ডের আবহে সে রাজ্যের একাধিক উপনির্বাচনে শাসক দল আগের চেয়েও বেশি ব্যবধানে জয়ী হয় কী করে? ভোটে রিগিং কিংবা ইভিএম কারচুপির তত্ত্বে বড়জোর কিছু ক্ষেত্রে জয়ের ব্যবধানে হেরফের ঘটতে পারে, জনাদেশ আমূল পাল্টে যেতে পারে না। গা- জোয়ারি অথবা জোচ্চুরিরর ভোট শেষ কথা বলে না, ব্যক্তি-মানুষের ভোটই গণতন্ত্রে নির্ণায়ক শক্তি। অর্থাৎ, আরজি কর আবহে বঙ্গের প্রায় সর্বত্র যে প্রতিবাদের আগুন দেখা গেছে, ভোটের বাক্সে তার কোনও প্রতিফলনই ঘটেনি। তা হলে রায় শোনার পর এত মানুষের হতাশ কণ্ঠস্বর কীসের ইঙ্গিত? আদপে এটা আবেগ, ঘটনাকে নৈর্বক্তিক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখার চেষ্টা নয়।
নাগরিক সমাজের হতাশার আরও একটি কারণ, ‘প্রকৃত অপরাধীদের’ বাঁচাতে ধৃত সিভিক ভলান্টিয়ারকে নাকি বলির পশু করা হয়েছে। কে করল? সিবিআই? কেন করল? দিদিভাই-মোদিভাই সেটিং তত্ত্ব? রাজনৈতিক লড়াইয়ে সার্বিক ভাবে কেউ কাউকে জমি ছেড়ে দেয় না। চার বছর আগে বঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনে সে রাজ্যের শাসকদলকে পরাজিত করতে কেন্দ্রের শাসকদল কার্যত সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিলো। দলের শীর্ষ নেতারা প্রায় সকলে বঙ্গে মাটি কামড়ে প্রচার চালিয়েছিলেন। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী প্রতি জেলা তো বটেই, এমনকী মহকুমাস্তরে জনসভা করেছিলেন। একটি ক্ষমতাশালী আঞ্চলিক দলের সঙ্গে কেন্দ্রের শাসক দলের কোনও কোনও ক্ষেত্রে ইস্যুভিত্তিক’ রাজনৈতিক সেটিং ‘যে একেবারেই হয় না তা নয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত একটি বড় রাজ্য থেকে সেটিং তত্ত্বের কারণে পরাক্রমী শাসকদল মুখ ফিরিয়ে থাকবে, এ কখনও বিশ্বাসযোগ্য? যদি তাই হয়, সে ক্ষেত্রে যে নবীন পট্টনায়েকের বিজু জনতা দলের সঙ্গে বিজেপির সম্পর্কের তথাকথিত উষ্ণতা থাকা সত্ত্বেও, সেই রাজ্যটির ক্ষমতা দখল করতে কেন্দ্রের শাসক দল অমন মরিয়া হয়ে উঠেছিল কেন? কেন চব্বিশের লোকসভা নির্বাচনে নবীনের দলকে ওড়িয়ায় কার্যত নিশ্চিহ্ন করে দিল কেন্দ্রের শাসকদল? অতএব সেটিং তত্ত্ব, বিশেষত একটি গুরুতর অপরাধের ঘটনায়, সমাজের সর্বস্তর যেখানে প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে আসে, প্রতিবাদ যখন এক সর্বগ্রাসী চেহারা নেয়, সেখানে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা অথবা রাজ্য সরকার ‘প্রকৃত অপরাধীদের’ বাঁচাতে চাইবে কেন? তর্কের খাতিরে যদি ধরে নেওয়া যায় যে, সাজাপ্রাপ্ত আসামি ছাড়াও আরও অপরাধী জড়িত ছিল এবং তারা অত্যন্ত প্রভাবশালী, সর্বোচ্চ নেতৃত্বের ঘনিষ্ঠ বৃত্তে থাকা এক বা একাধিক কেউকেটা- জনতার সম্মিলিত প্রতিবাদের এমন অগ্ন্যুৎপাত দেখার পরেও কোন আহাম্মক শাসক তাকে/তাদের বাঁচাতে চাইবে? শাসক চাইলে অমন দশটা কেউকেটা উৎপন্ন করতে পারে, কিন্তু জনরোষে সরকার চলে গেলে আম-ছালা সবই যায়! এই সারসত্য বুঝতে বিজেপি বা তৃণমূলের মতো পরিণত মাথা হতে হয় না। বিশেষভাবে যেখানে আরজি কর কাণ্ডে আবহেই প্রতিবেশী রাষ্ট্রে জনবিক্ষোভের ফলিত প্রয়োগে তাসের ঘরের মতো একটি স্বৈরাচারী সরকারের পতন দেখেছেন সকলে।
আরজি কর কাণ্ডে সংশ্লিষ্ট হাসপাতাল প্রশাসন এবং পুলিশের বিবিধ ভূমিকা ও আচরণ বহু সন্দেহের জন্ম দিয়েছে এটা সত্য। কিন্তু সেই সব ‘মিসিং লিঙ্ক’-এর সমাধান কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা ইচ্ছাকৃত ভাবে করেনি, এমন সরলীকরণের মধ্যেই যতই আবেগ থাক, তিলমাত্র যুক্তি নেই। তাদের ব্যর্থতা নিয়ে নিশ্চয়ই আলোচনা হতেই পারে। তবে সে প্রসঙ্গ ভিন্ন।

Dainik Digital

Share
Published by
Dainik Digital

Recent Posts

১০০ ও ২০০ টাকার নোট নিয়ে নয়া নির্দেশ রিজার্ভ ব্যাঙ্কের!!

অনলাইন প্রতিনিধি :-১০০ এবং ২০০ টাকার নোটের বিষয়ে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের বড়সড় সিদ্ধান্ত।সোমবার জারি করা এক…

3 hours ago

আরজি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আগুন!!

অনলাইন প্রতিনিধি :-আচমকাই আগুন লাগে আরজি কর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে । সোমবার সন্ধ্যায় আগুন…

9 hours ago

সিন্ধু তীরের জলযুদ্ধ!!

পহেলগাঁওয়ে সন্ত্রাসী হানার একদিন পরে বৃহস্পতিবার ভারতের জলসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব দেবশ্রী মুখার্জি পাকিস্তানের জলসম্পদ মন্ত্রণালয়ের…

1 day ago

বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়ানোর অপরাধে নিষিদ্ধ করা হল ১৬ টি ইউটিউব চ্যানেল!!

অনলাইন প্রতিনিধি :-পহেলগাঁও হামলার পর থেকে কেন্দ্রীয় সরকার অ্যাকশন মোড অন করেছে । সোমবার কেন্দ্রীয়…

1 day ago

পুনরুজ্জীবনের স্বপ্ন অপূর্ণই জুটমিল এখন ভূতুড়ে বাড়ি!!

অনলাইন প্রতিনিধি :-রাজ্যবাসীর যে স্বপ্ন নিয়ে আশির দশকে গড়ে উঠেছিল রাজ্যের বৃহৎ -মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠান…

1 day ago

কাঞ্চনপুরে ভুট্টার রেকর্ড উৎপাদন, বাজারে বিক্রি নেই হতাশায় কৃষক!!

অনলাইন প্রতিনিধি :-খরিফ মৌসুমে কাঞ্চনপুর মহকুমার বিভিন্ন কৃষি অঞ্চল জুড়ে ভুট্টা উৎপাদন অতীতের সব রেকর্ড…

1 day ago