লাখ লাখ মানুষের তৃষ্ণা মেটাচ্ছেন ‘মটকা ম্যান’

 লাখ লাখ মানুষের তৃষ্ণা মেটাচ্ছেন ‘মটকা ম্যান’
এই খবর শেয়ার করুন (Share this news)

রাস্তার ধারে টিনের ছাউনি দেওয়া ছোট্ট একটি স্টল। লোহার স্ট্যান্ডের উপর রাখা আছে বেশ কিছু মাটির কলসি। স্থানীয়দের কাছে যা পরিচিত মটকা নামে। ভোরবেলা জলের গাড়ি নিয়ে এই দোকানে হাজির হন এক বৃদ্ধা। সযত্নে জন ভরে রাখেন এই মটকায়। রাজধ্নাঈ দিল্লীর রাস্তায় প্রতিদিন সকালেই দেখা যায় এই দৃশ্য। না, কোনও সরকারি পরিষেবা নয়। ব্যক্তিগত উদ্যোগে তৃষ্ণার্ত পথযাত্রী এবং দরিদ্রদের তৃষ্ণা মেটানোর দায়িত্ব নিজের কাছে তুলে নিয়েছেন আলাগারথানম নটরাজ। অবশ্য প্রাক্তন বেঙ্গালুরু নিবাসীকে আলাগারথানম নামে চেনে না রাজধানীবাসী। তাদের কাছে বৃদ্ধ শুধুই ‘মটকা ম্যান।’
‘মটকা ম্যান’ নামটা দিয়েছিলেন আলাগারথানমের একমাত্র কন্যা নাতাশা নটরাজন। ‘ক্ষ্যাপা’ বাবার একবারের জন্মদিনে এই নাম দিয়েছিলেন তিনি। আর সেই থেকে পিতৃপ্রদত্ত নামটাই হারিয়ে যায় আলাগারথানমের জীবন থেকে। নিজের বাড়ির নেম প্লেটেও লেখা রয়েছে ‘মটকা ম্যান।’

প্রথমদিকে অবশ্য ‘ক্ষ্যাপা’ বাবার কাজকর্ম মোটেই ভাল লাগেনি নাতাশার। প্রতিদিন ভোর পাঁচটায় ওঠেন রাস্তার মোড়ে মোড়ে কলসি ভরার কাজ দেখে যথেষ্টই বিব্রত হতেন দিল্লী আইআইটির প্রাক্তনী। অবশ্য ভূলতা ভাঙতে বেশি সময় লাগেনি। যখন রাজধানীর বুকে একদিন স্বচক্ষে দেখলেন নাতাশা নিজের বাবার হাতে ভরা কলসি থেকে জনা দশেক মজুর রাস্তা মেরামতের কাজের ফাঁকে জল পান করছেন, তখনই বুঝলেন বাবার কাজের মহাত্ম্য ঠিক কোন জায়গায়। আর সেই বছরেই বাবার জন্মদিনের কেকের ওপর ক্রিম দিয়ে লিখলেন ‘মটকা ম্যান।’
ভারতে জন্ম হলেও, কর্মসূত্রে দীর্ঘ ৪০ বছর লন্ডনে কাটিয়েছেন নটরাজন। সেখানের ছিল তার ছোট্ট সুভ্যেনির শপ। উপার্জন ভালোই হতো।
তবে বছর দশেক আগে ক্যানসারে আক্রান্ত হয় নটরাজ। চিকিৎসার পর, দোকানের দায়ভার অন্যের হাতে তুলে দিয়ে তিনি চলে আসেন মাতৃভূমিতে। সেটা ২০১৪ সালের কথা। প্রায় চার দশক পর দেশে ফেরার পর বেশ অবাকই হয়েছিলেন নটরাজ। বাইরের পৃথিবী আমূল বদলে গেলেও, জনপরিষেবা অবস্থা রয়ে গেছে একইরকম।
রাজধানীর মতো শহরে সেইভাবে পানীয় জলের বন্দোবস্ত নেই। অধিকাংশ মানুষকেই নির্ভর করতে হয় টাইম কলের জলের ওপর। তাছাড়া প্যাকেটজাত জলের ব্যবস্থা আছে ঠিকই। কিন্তু সেই জল কেনার সাধ্য আদৌ কি রয়েছে সাধারণ দরিদ্র মানুষ কিংবা শ্রমিকদের?

সেই ২০১৪ সাল থেকেই লড়াই শুরু হয়েছিল নটরাজের। গ্রীষ্মের দিনে দরিদ্রদের তৃষ্ণা মেটাতে বাড়ির বাইরে লাগিয়েছিলেন ওয়াটার কুলার যন্ত্র। কিন্তু তাতে কি আর একটা গোটা শহরের তেষ্টা মেটে?
পাশাপাশি এই যন্ত্র বেশ ব্যায়বহুল হওয়ায় দিল্লির বুকে একাধিক যন্ত্র স্থাপন করাও ছিল তার সাধ্যের বাইরে। ফলে বিকল্প পথের অনুসন্ধান শুরু করেন নটরাজন। সঞ্চয় ভেঙে কিনে ফেলেন একটি জলের গাড়ি। পাশাপাশি শহরের একাধিক অঞ্চলে স্থাপন করেন মটকা স্ট্যান্ড। প্রতিদিন ভোরের আলো ফুটলেই সেই গাড়িতে জল ভরে রাস্তায় নামেন নটরাজন। দিল্লি জুড়ে প্রায় ৭০ টিরও বেশি মটকায় ভরে রাখেন ৮০০ লিটার জল। বিনামূল্যে এই মটকা থেকে জল খেতে পারেন দরিদ্র পথযাত্রীরা।
নটরাজন জানান, শুরুতে প্রচুর বাঁধার মুখে পড়তে হয়েছিল তাকে। ‘আমার মটকাগুলোকে পাত্তা দেয়নি সাধারণ মানুষ। অনেকে সন্দেহের চোখে দেখেছে। কেউ কেউ ভেবেছে আমি হয়তো আম আদমি পার্টির লোক। রাজনৈতিক অভিসন্ধিতে এই কাজ করেছি। ভবিষ্যতে কাউন্সিলর বা এমএলএ হতে চাই বলে ছদ্ম জনসেবা করে বেরাচ্ছি। নটরাজন আরও বলেন, সমাজসেবা জিনিসটা মোটেই সহজ না। খোদ মহাত্মা গান্ধীকেও হাজারো ঝামেলায় পড়তে হয়েছিল।’ প্রায় এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে চললেন নটরাজন। গান্ধী দর্শনে অনুপ্রাণিত বলেই হয়তো নটরাজন হাল ছাড়েনি। কেন করেন? টেলিফোনে প্রশ্ন করতেই জবাব দিলেন ‘মটকা ম্যান।’ যাতে করে রাজধানীর পথেঘাটে থাকা তৃষ্ণার্ত মানুষ অন্তত একঢোল জল পান করতে পারেন।’
সরকারি কোনও সাহায্য নেই। তার কাজে উদ্বুদ্ধ হয়ে অনেক কিশোর, তরুণ এগিয়ে এসেছেন। সমাজমাধ্যমে তাকে কুর্নিশ জানিয়েছেন মাহিন্দ্রা সংস্থার কর্ণধার আনন্দ মাহিন্দ্রাও। কন্যার দেওয়া নামতা বোধহয় সার্থক হয়েছে তার। আজ দিল্লিবাসী তাদের ‘মটকা ম্যান’কে একডাকে চেনেন।

Dainik Digital

Dainik Digital

Leave a Reply

Your email address will not be published.