সঙ্কটে জীবন বিমা
জীবন বিমার কথা উঠলেই সবার আগে মনে পড়ে যায় একটি স্লোগান। কানে বেজে ওঠে সেই সৃষ্টি। “জিন্দেগীকে সাথ ভি জিন্দেগীকে বাদ ভি”। ভারতীয় জীবন বিমার (এলআইসি) হাত ধরে দূরদর্শনের পর্দায় ভেসে ওঠা, বেতারে শোনা সেই স্লোগান প্রতিটি ভারতীয়ের জীবনের সাথে জড়িয়ে গেছে। অনিশ্চিত জীবনে যুগ যুগ ধরে মানুষকে নিশ্চয়তার আশ্বাস জুগিয়ে এসেছে এই স্লোগান। যে জীবন বিমা মানুষকে ভরসা ও আস্থা জুগিয়েছে, আজ সেই জীবন বিমাই সঙ্কটে। যে জীবন বিমা যুগ যুগ ধরে মানুষের ভবিষ্যৎ সুনিশ্চিত করেছে, আজ সেই জীবন বিমারই ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে গেছে বলে চতুর্দিকে শোরগোল শুরু হয়েছে।
অনেকে এমনও দাবি তুলেছে যে জীবন বিমায় এখন নিজেরই বিমা করা দরকার। পরিস্থিতি সেই দিকেই মোড় নিচ্ছে বলে অনেকের অভিমত।
লাইফ ইনসিয়োরেন্স কর্পোরেশন (এলআইসি) পরাধীন ভারতে গড়ে ওঠা এই ভিত এত বছর ধরে ছিলো আম ভারতীয়ের নিশ্চয়তার ঠিকানা। আজ সেই এলআইসিকে ঘিরে আশঙ্কার মেঘ তৈরি হয়েছে। বিমা সংস্থার সেই ঐতিহাসিক স্লোগান “জিন্দেগীকে সাথ ভি, জিন্দেগীকে বাদ ভি” সুস্থ জীবনের স্বপ্ন দেখা কোটি কোটি ভারতীয়ের ভরসা হয়ে উঠেছিলো।এত বছর ধরে মানুষের বিশ্বাস টাল খায়নি। কিন্তু সম্প্রতি দেশের প্রথম সারির একটি শিল্পগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে (আদানি) ওঠা নানা অভিযোগের সঙ্গে এলআইসির নাম জড়িয়ে যাওয়ায় সেই বিশ্বাস এবং নিশ্চয়তা এখন খাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে -এমনটাই অভিযোগ তুলেছে দেশের প্রায় সব কয়টি বিরোধী রাজনৈতিক দলই।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই অভিযোগ ও আশঙ্কা কতটা বাস্তবসম্মত? খবরে প্রকাশ, আদানি গোষ্ঠীতে সব মিলিয়ে ৩৬ হাজার ৪৭৪ কোটি ৭৮ লক্ষ টাকা বিনিয়োগ করেছে এলআইসি। এই আশঙ্কার মধ্যে এলআইসি জানিয়েছে, আম নাগরিকের গচ্ছিত আমানত তাদের কাছে সুরক্ষিতই রয়েছে। এ নিয়ে আশঙ্কার কোনও কারণ নেই। তা সত্ত্বেও আম নাগরিকের আতঙ্ক কাটছে না। যদি কিছু ঘটে যায়, তাহলে কী হবে? এই চিন্তায় আম ভারতীয়ের ঘুম ছুটে গেছে। অথচ এই জীবন বিমাই যুগ যুগ ধরে কোটি কোটি ভারতীয়ের নিশ্চিত ঘুমের টনিক হিসেবে কাজ করে গেছে।তথ্য খুঁজে জানা যায়, ১৮১৮ সালে ব্রিটেন থেকে প্রথম ভারতে আমদানি হয় জীবন বিমার।
ভারতীয়দের জন্য প্রথম বিমা সংস্থার পত্তন ঘটে ১৮৭০ সালে। তারপর থেকে গঙ্গা, যমুনা দিয়ে অনেক জল গড়িয়েছে। ধাপে ধাপে ভারতে গড়ে উঠেছে একাধিক বিমা কোম্পানি ও বিমা সংস্থা। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ধীরে ধীরে বিমা সংস্থাগুলির জাতীয়করণের দাবি জোরালোভাবে উঠতে থাকে। ১৯৫৬ সালে বিমা সংস্থার জাতীয়করণ ঘটে। সেই থেকে জাতীয় সম্পত্তিতে পরিণত হয় লাইফ ইনসিয়োরেন্স কর্পোরেশন। সেই সময় ১৫৪টি ভারতীয় বিমা সংস্থা, ১৬টি ভারতবহির্ভূত বিমা সংস্থা এবং ৭৫টি প্রভিডেন্টের একত্রীকরণ ঘটিয়ে এলআইসির পত্তন হয়। তদানীন্তন ভারত সরকার এলআইসিতে পাঁচ কোটি টাকা ঢালে।
২০২২ সালের সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশে শাখা বিস্তারকারী সংস্থাগুলির মধ্যে এলআইসি-ই বৃহত্তম। তাদের সারা দেশে আটটি জোনাল, ১১৩টি বিভাগীয়, ৭৪টি গ্রাহক দপ্তর, শাখা দপ্তর রয়েছে ২০৪৮টি, স্যাটেলাইট দপ্তর রয়েছে ১৫৪৬টি, ৪২ হাজার প্রিমিয়াম কালেকশন সেন্টার, সাড়ে তেরো লক্ষ এজেন্ট এবং গ্রাহক সংখ্যা ২৫ কোটি। প্রশ্ন হচ্ছে, কেন এই আশঙ্কা তৈরি হয়েছে? বিলগ্নিকরণ নীতির আওতায় ২০২২ সালের মে মাসে খোলা বাজারে এলআইসির আইপিও ছাড়ে কেন্দ্রের মোদি সরকার। তাতে প্রথম দিকে কোনও সমস্যা না হলেও, যত সময় এগিয়েছে সমস্যা তৈরি হয় শেয়ার বাজারে পতন শুরু হতেই।
এলআইসির দাবি, আদানি গোষ্ঠীর শেয়ারে ৩৬ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করলেও, বর্তমান সময়ে তার মূল্য ৫৬ হাজার কোটি টাকা। ফলে ক্ষতির সম্ভাবনা নেই। সম্ভাবনা নেই লাভেরও। মূলধনের মাত্র ১ শতাংশই আদানি গোষ্ঠীতে বিনিয়োগ করা হয়েছে বলে দাবি এলআইসির। কিন্তু তাতেও অনিশ্চয়তা কাটছে কই? বিশেষজ্ঞরা সাহারা গোষ্ঠীর উদাহরণ তুলে আনছেন। তাদের যুক্তি, আজও সাহারা থেকে বিনিয়োগ এবং লাভের টাকা ফেরত পাননি সাধারণ মানুষ। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠেছে, সাধারণ মানুষের কষ্টার্জিত টাকা এমন ঝুঁকিপূর্ণভাবে কেন বিনিয়োগ করলো এলআইসি ? এর জবাব হয়ত কোনও দিনই পাওয়া যাবে না । যুগ যুগ ধরে যে ভরসা জুগিয়ে চলেছে এলআইসি, সঙ্কট কাটিয়ে ফের একবার মানুষের নিশ্চয়তার ঠিকানা হয়ে উঠতে পারে কিনা সেটাই এখন দেখার।