সতর্কতা ও চ্যালেঞ্জ
২০২০ সালের জুন মাসে পূর্ব লাদাখের গালওয়ানে ভারত ও চিনের সেনাদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর দুই দেশের বেশ কিছু সেনা নিহত হন।গালওয়ান উপত্যকা সংঘর্ষের পর গত বছর ডিসেম্বরে অরুণাচল প্রদেশের তাওয়াং সীমান্তেও দুই দেশের সেনার সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছিলেন। যদিও এই ঘটনায় উভয় দেশের বেশ কিছু সেনা আহত হলেও প্রাণহানির কোন ঘটনা ঘটেনি।লাদাখ, অরুণাচলের পর সিকিমের সংঘাত পরিস্থিতি এখনও কমেনি।অর্থাৎ প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা থেকে এখনও চিনের লালফৌজকে সরানো যায়নি।
এই নিয়ে দুই দেশের লাগাতর বৈঠক হলেও কোন সদর্থক প্রভাব পড়েনি।ভারত ও চিনের মধ্যে এই জটিল ও উত্তপ্ত সঙ্কটময় পরিস্থিতির মধ্যেই সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশনের বৈঠক শুরু হয়েছে নয়াদিল্লীতে। গালওয়ানের ঘটনার পর প্রায় আড়াই বছর কেটে গেছে। কিন্তু এই মাঝখানের সময়টুকুতে চিনের কোন প্রতিরক্ষামন্ত্রকে ভারত সফরে আসেননি। গত কয়েক বছরে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের এই অস্থিরতার মধ্যেই বৃহস্পতিবার ভারত সফরে এসেছেন চিনা প্রতিরক্ষামন্ত্রী লি সাংফু।যদিও নয়াদিল্লীতে অনুষ্ঠিত এসসিও বা সাংহাই সহযোগিতা সংস্থার সম্মেলনে অংশ নিতেই চিনা প্রতিরক্ষামন্ত্রীর ভারত সফর। কিন্তু বিষয়টিকে শুধুই একটি সম্মেলন মঞ্চ হিসাবে আদৌ দেখছেন না বিশ্বের তাবড় কূটনৈতিক মহল। দিল্লীতে পৌঁছেই চিনা প্রতিরক্ষামন্ত্রী ভারত-চিন সীমান্ত এলাকার উন্নয়নের পাশাপাশি দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের বিষয় নিয়ে ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছেন। ভারতের তরফে স্পষ্ট জানিয়ে দেওয়া হয়েছে সীমান্তে শান্তি ও স্থিতাবস্থার উপরই ভারত ও চিনের সম্পর্কের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। আসলে গালওয়ান সীমান্তে আড়াই বছর আগে সংঘটিত সীমান্ত বিবাদকে ঘিরে ভারত ও চিনের মধ্যে সম্পর্ক ও ঘটনাপ্রবাহ যে দিকে গড়াচ্ছে তাতে কোন সম্মেলন মঞ্চই হোক বা আন্তর্জাতিক কোন মঞ্চ – তাতে উভয় দেশের সম্পর্ক সহসাই শোধরানোর কোন সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না।
কেননা লাদাখ সীমান্তের গালওয়ানে কিংবা অরুণাচলের তাওয়াং কিংবা সিকিম সীমান্তে চিন ও ভারতের মধ্যে যা ঘটছে তা দুই দেশের মধ্যে বৃহত্তর সঙ্কটের একটি উপসর্গ মাত্র। মূল সমস্যাটা হল, দক্ষিণ এশিয়াকে নিজের প্রভাব বলয়ের মধ্যে আনতে দীর্ঘদিন ধরে চিনের যে অভিলাষ কাজ করছে সেখানে বড় প্রাচীর হয়ে দাঁড়িয়েছে ভারত। আর এটাই চিনেক ক্ষুব্দ করার কারণ।
আর সেই থেকেই চিন কখনও লাদাখে, কখনও সিকিমে আবার কখনও অরুণাচলের ভারত ভূখণ্ডের ভৌগোলিক স্থানের নাম পরিবর্তন করার দুঃসাহস দেখিয়ে ভারতকে চাপে রাখতে চাইছে। সামরিক আগ্রাসন আর আর্থিক উপনিবেশবাদের জোরে চিন যতই এই মুহূর্তে বিশ্বের ১ নম্বর শক্তি হিসাবে তুলে ধরার চেষ্টা করুক না কেন, সম্পর্কের ভারসাম্যের কূটনীতিতে ভারতের অবস্থান যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে খুবই ঘনিষ্ঠ ও আন্তরিক হওয়ায় চিনবিরোধী জোটে ভারতের সরাসরি আমেরিকার সঙ্গে সহাবস্থান চিনের মাথাব্যথার বড় কারণ। তাই দুই দেশের পরিস্থিতির সমাধান এবং সম্পর্কের উন্নয়নের প্রশ্নে সাংহাই সহযোগিতা সংস্থার সম্মেলন মঞ্চ যে কোন আশার আলো দেখাতে পারবে না সেটা এ রকম পরিষ্কার।সাম্প্রতিক চিনের অতিরিক্ত আগ্রাসী মনোভাব রুখতে ভারতের মার্কিন বান্ধব পদক্ষেপ চিনের জন্য যে গলার কাঁটা সেটা অনুধাবন করার জন্য কূটনৈতিক হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। আমেরিকার সঙ্গে ভারত একযোগে অতি আধুনিক রণতরী দক্ষিণ চিন সাগরে মোতায়েন করার বিষয়টি এতটাই অপ্রত্যাশিত ও বিস্ময়কর চিনের কাছে, যেখানে ভারতের সঙ্গে ওই চিন সাগরের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোন যোগসূত্র নেই। অথচ সেই স্পর্শকাতর স্থানেই ভারত- আমেরিকার যৌথ যুদ্ধ জাহাজ মোতায়েন রয়েছে।
স্বাভাবিক কারণেই গত ৬০ বছরের বেশি সময় ধরে ভারত-চিনের সীমান্ত সমস্যা বর্তমানে যে পর্যায়ে এসেছে তাতে রাজনৈতিক আলোচনার জায়গাটি ক্রমেই অসাধ্য হয়ে সামরিক দিক দিয়ে কঠোর যে অবস্থানে গিয়ে দাঁড়াচ্ছে— সেই প্রেক্ষাপটে দিল্লীতে সাংহাই সহযোগিতা গোষ্ঠীর সম্মেলন যতটা না গুরুত্বপূর্ণ, তার চেয়ে বেশি নজর ভারত-চিন প্রতিরক্ষামন্ত্রীদের আলোচনা বৈঠক নিয়ে।গোটা বিশ্বই তাকিয়ে আছে এর প্রভাব ও প্রতিক্রিয়ার উপর। সেই দিক এই সম্মেলনে ভারত চিন সম্পর্কে কী বার্তা দেয়, কতটা কঠোর অবস্থান নিতে পারবে ভারত তারও একটা পরীক্ষা এই সম্মেলন মঞ্চ।