সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ!!

 সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ!!
এই খবর শেয়ার করুন (Share this news)

অনলাইন প্রতিনিধি :- বৃহস্পতিবার সরযু নদী থেকে জল তুলে সম্পন্ন হল কলসপুজন। সন্ধ্যায় সমাপন হল তীর্থপুজা, জলযাত্রা ও গন্ধ অধিবাস। সেই সঙ্গে সম্পন্ন হয়েছে ব্রাহ্মণ-বটুক-কুমারী-সুভাষণী পূজা এবং বর্ধিনী পুজা। যে কোনও বিগ্রহের অভিষেকে সব তীর্থের জল লাগে। অযোধ্যার সরযূর জলকে তীর্থের পুণ্যতোয়া হিসাবে গণ্য করে মন্দিরের গর্ভগৃহ অপাপবিদ্ধ করা হল। গন্ধ অধিবাসে সেই জলে বিভিন্ন ধরনের ধূপ- সুগন্ধ মিশ্রিত হল। একই সঙ্গে গণেশ-বরুণ পূজা, মাতৃ পূজা, বাস্তু পূজার মাধ্যমে মূল পূজার অনুষ্ঠানের সূচনা হল। বস্তুত, এই সঙ্গে শুরু হয়ে গেছে প্রতীক্ষার অন্তিম প্রহরের গণনা। বিগ্রহের প্রাণপ্রতিষ্ঠা করবেন তিনি। সেই উপলক্ষে এগারো দিন আগে থেকে শাস্ত্রীয় বিধি মেনে বিশেষ ব্রত পালন শুরু করেছেন প্রধানমন্ত্রী। বৃহস্পতিবার ঘড়ির কাঁটা ঠিক দ্বিপ্রহর পৌনে একটা। রামলালার বিগ্রহ বসেছে গর্ভগৃহের বেদিতে। এখনই অযোধ্যা যেন জনজোয়ার। গুজরাট থেকে আসা ১০৮ ফুট লম্বা ধূপকাঠি বুধেই প্রজ্বালিত হয়েছে। বুধেই সম্পন্ন হয়েছে প্রায়শ্চিত্ত ও কর্মকোটি পূজা। যে কোনও যাগযজ্ঞ, পূজার আগে কর্মকোটি পূজা হল আদর্শ শাস্ত্রবিধি। কর্মকোটির অর্থ, কোটি কোটি জন্ম ধরে আমরা যে সব কর্ম করেছি, তাতে যা অন্যায় হয়েছে, তার প্রায়শ্চিত্ত করা। আজ অর্থাৎ ১৯ জানুয়ারী মন্দিরে নবগ্রহ স্থাপন ও যজ্ঞের আগুন জ্বালানো হবে। সম্পন্ন হবে ঔষধি অধিবাস, কেশর অধিবাস, ঘৃত অধিবাস এবং ধান্য অধিবাস। অর্থাৎ, মূর্তির অভিষেকের সময়ে দই, দুধ, ঘি, মধু ও শর্করা এই পঞ্চ গব্যসহযোগে অধিবাস হবে। আগামীকাল ২০ জানুয়ারী মন্দিরের সম্পন্ন হবে বাস্তু শান্তির পূজা, পাশাপাশি হবে শর্করা অধিবাস, ফল অধিবাস এবং পুষ্প অধিবাস। মূল পর্ব অর্থাৎ বিগ্রহের প্রাণপ্রতিষ্ঠার আগের দিন, ২১ জানুয়ারী, মূর্তিকে স্নান করানোর পরে ভগবানকে বিশ্রাম করার সুযোগ দেওয়া হবে। রাতে হবে শয্যা অধিবাস। ২২ জানুয়ারী, সোমবার শাস্ত্রীয় বিধিনিয়মে মেনে পৌষ মাসের শুক্ল কুর্ম দ্বাদশীতে বিক্রম সম্বৎ ২০৮০-এর বৈকালিক অভিজিৎ মুহুর্তে ( ১২টা বেজে ২০ মিনিটে) প্রাণপ্রতিষ্ঠা হবে রামলালার। প্রাণপ্রতিষ্ঠা করবেন নরেন্দ্র মোদি। ধর্মীয় ভাবাবেগে উদ্বেল হবে গোটা দেশ। না, এই ষোড়শোপচারের সঙ্গে নির্বাচনের কোনও সম্পর্ক নেই। সেই আঙ্গিকে একে দেখাও বিধেয় নয়। নরেন্দ্র মোদি, বিজেপি, আরএসএস অযোধ্যার রামমন্দির নির্মাণ সম্পন্ন করে, লোকসভা নির্বাচনের মন্দিরে প্রাক্কালে প্রাণপ্রতিষ্ঠা করে, শুধু সেই আবেগে চব্বিশের লোকসভা নির্বাচনে ভোট-বৈতরণী পার করতে চাইছেন এমনটা ভাবলে অতি সরলীকরণ হবে। দল হিসাবে বিজেপি ও তাদের থিঙ্কট্যাঙ্ক আরএসএস গোড়া থেকেই ভারতবর্ষের নিজস্ব ধর্মীয় পরিচিতি তৈরি করতে চেয়েছে। কেউ সেই পরিচিতিকে অস্বীকার করে এ দেশের বহুত্ববাদের স্বরূপটিকে সামনে নিয়ে আসতেই পারেন। কিন্তু সে প্রশ্ন ভিন্ন। যার মনে করেন, বিজেপির ধর্মীয় উন্মাদনা নিছক নির্বাচনে জয়লাভ নিমিত্তে, তাদের ভাবনায় গলদ রয়েছে। মূল বিষয় হল, ভারতবাসীকে একটি জারী হিসাবে পরিচিতি দিয়ে, তাদের মননে এই ধর্মীয় চেতনা তৈরির প্রচেষ্টা বিজেপির রাজনীতির নিউক্লিয়াস। বিজেপির কাছে এটাই ভারতীয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রক্ষা বা পুনরুদ্ধারের কর্মসূচি। সেই প্রেক্ষাপটে ‘বহিরাগত’ মোগলদের তৈরি বাবরি মসজিদ ভেঙে ওই একই স্থানে রাম মন্দির নির্মাণ সেই প্রচেষ্টারই একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। আগামী সোমবার মন্দির উদ্বোধনের পরে রামমন্দির শুধুমাত্র একটি মন্দির পরিচিত নিয়ে থাকবে না, বরং তা হয়ে উঠবে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য পুনরুদ্ধারের প্রতীক। এই কাজটিই করতে চলেছেন নরেন্দ্র মোদি আরও সম্প্রসারিত অর্থে দেখলে, বাজপেয়ী-আদবানির স্বপ্নকে সাকার করতে চলেছেন। কুণ্ঠাহীন ভাবে মোদি নিজেকে প্রাচীন হিন্দু সভ্যতা পুনর্জাগরণের প্রতীক হিসাবে তুলে ধরেছেন। প্রচেষ্টার এই বৃত্তটিকে নিছক ভোটব্যাঙ্কের গাটীগণিত দেখলে ভুল হয়ে যাবে। সবটাই ভারতীয়কে তার সাংস্কৃতিক পরিচিতি তথা সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ তৈরির প্রচেষ্টা। হিন্দুত্বকে দৈনন্দিন সংস্কৃতির ঐতিহ্য হিসাবে ভাবতে শেখানোর প্রচেষ্টা। লোকসভা নির্বাচনে জয়-পরাজয়ের বাইরে দেশে ধর্মীয় সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদের এমন বীজ মোদি বপন করে ফেলেছেন, যাকে অগ্রাহ্য করে ভবিষ্যকে কোনও পাল্টা ভাষ্য, সে রাজনীতি হোক বা সমাজনীতি, নির্মাণ করা সহজ হবে না।

Dainik Digital

Dainik Digital

Leave a Reply

Your email address will not be published.