সিন্ধু তীরের জলযুদ্ধ!!

 সিন্ধু তীরের জলযুদ্ধ!!
এই খবর শেয়ার করুন (Share this news)

পহেলগাঁওয়ে সন্ত্রাসী হানার একদিন পরে বৃহস্পতিবার ভারতের জলসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব দেবশ্রী মুখার্জি পাকিস্তানের জলসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব সৈয়দ আলী মুর্তজাকে চিঠি লিখিয়া জানান, ভারত ১৯৬০ সালের সিন্ধু জল চুক্তি রদের সিদ্ধান্ত করিয়াছে এবং তাহা অবিলম্বে কার্যকর হইবে। বিশ্বব্যাংকের মধ্যস্থতায় ১৯৬০ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানের করাচিতে সিন্ধু জল চুক্তিতে স্বাক্ষর করিয়াছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু ও পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান। পাকিস্তান তাৎক্ষণিকভাবে এই চিঠির প্রতিক্রিয়া জানাইয়া বলিয়াছে, ভারত একতরফাভাবে সিন্ধু জলচুক্তি স্থগিত করিতে পারে না। ইহা যুদ্ধের শামিল। পাকিস্তানও ঘোষণা দিয়াছে তাহার সিমলা চুক্তি বাতিল করিতেছে। পরমাণু শক্তিধর দুই দেশের মধ্যে চরম উত্তেজনা বিরাজ করিতেছে।
এই গ্রহে এক সময়ের প্রমত্তা সকল নদীরই জল শুকাইয়া যাইতেছে। সিন্ধু নদের ধারারও একই হাল।কিন্তু এই নদের জলধারাই পাকিস্তানের জীবনসুধা। পাক সরকার গণমাধ্যমকে বলিয়াছে, পহেলগাঁও ঘটনা অজুহাত করিয়া ভারত সিন্ধু জলচুক্তি স্থগিতের যে চেষ্টা করিতেছে ইহা পাকিস্তানের ওপর চাপ সৃষ্টির প্রচেষ্টা। স্বাক্ষরিত একটি দ্বিপক্ষীয় আন্তর্জাতিক চুক্তি লঙ্ঘন করিয়া নয়াদিল্লী যদি পাকিস্তানের জল বন্ধ করিয়া দেয় তবে তাহা আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন এবং যুদ্ধ ঘোষণার শামিল হইবে। পাকিস্তানের বিদ্যুৎমন্ত্রী আওয়াইস লেখারিকে সামাজিক মাধ্যমে বলিতে দেখা যায়, বেপরোয়াভাবে ভারতের সিন্ধু জলচুক্তি স্থগিত জলযুদ্ধের শামিল। ইহা একটি কাপুরুষোচিত, অবৈধ পদক্ষেপ।
তবে ইহাও সত্য, যুযুধান দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের যে টানাটানি তাহাতে পাকিস্তান জলযুদ্ধের আশঙ্কা করিয়া আসিতেছিল আগে হইতেই। ভৌগোলিকভাবে ভারতের অবস্থান উজানে রহিয়াছে। ভারতের পক্ষে জলপ্রবাহ বন্ধ করিয়া দিবার সুযোগ রহিয়াছে, যাহা পাকিস্তানের কৃষিক্ষেত্রে মারাত্মক প্রভাব ফেলিবে। পাকিস্তানের বিশেষ করিয়া পাঞ্জাবের কৃষি, ফসল, অর্থনীতি, যোগাযোগ ভাঙিয়া পড়িবে। ইহাতে দুই দেশের সম্পর্কে কী ধরনের প্রভাব পড়িবে, তাহা লইয়া দক্ষিণ এশিয়ার সকল দেশের রীতিমতো আলোচনার ঝড় বহিতেছে। ভারত সিন্ধুর জল বন্ধ করিলে সিন্ধু অববাহিকায় জলপ্রবাহ শুকাইয়া যাইবার আশঙ্কা রহিয়াছে। সিন্ধু নদের উৎপত্তি তিব্বতে। হিমালয়ের নানা পাহাড় খাত ধরিয়া জম্মু ও কাশ্মীর দিয়া পাকিস্তানে নামিয়া গিয়াছে। সিন্ধু এশিয়া মহাদেশের অন্যতম দীর্ঘ নদ।এই অঞ্চলের

অত্যন্ত সংবেদনশীল সীমান্ত দিয়া সিন্ধুর জলধারা প্রবাহিত হয়। ১৯৬০ সালে বিবদমান দুই প্রতিবেশী ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে জলের ন্যায্য বন্টন লইয়া এক ঐতিহাসিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হইয়াছিল। তৎকালীন বিশ্বব্যাংক সেই চুক্তিতে মধ্যস্থতা করে। ইতিহাসে সেই চুক্তি সিন্ধু নদের জলচুক্তি নামে পরিচিত। সেই চুক্তিতে সই করিয়াছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু এবং পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান। প্রসঙ্গত, সিন্ধু চুক্তি সম্পাদনের পর ভারতের সহিত পাকিস্তানের তিনটি বড় যুদ্ধ হইয়াছিল ১৯৬৫, ১৯৭১ এবং ১৯৯৯ সালে। যুদ্ধের কারণে কখনোই জলচুক্তি স্থগিত বা বাতিল করা হয় নাই। এইবার প্রথম ভারতের পক্ষ হইতে চুক্তি রদের ঘোষণা দেওয়া হইলো।
সিন্ধু জলচুক্তি বিশ্বের অন্যতম স্থিতিশীল আন্ত:সীমান্ত জলচুক্তি বলিয়া পরিচিত। সিন্ধু জলচুক্তি দুই দেশের মধ্যে তত্ত্বগতভাবে জলবণ্টন স্থির করিয়া থাকে। তবে বরাবরই এই চুক্তি ছিল বিরোধপূর্ণ। সিন্ধু নদের অববাহিকার ছয়টি নদী দুই দেশের মধ্য দিয়া বহিয়া গিয়াছে। চুক্তি অনুযায়ী ভারতের হাতে থাকিবে পূর্বাঞ্চলীয় তিন নদী-ইরাবতী,উপর উ বিপাশা ও শতদ্রুর নিয়ন্ত্রণ। অপরদিকেউ পাকিস্তানকে দেওয়া হইয়াছে পশ্চিমাঞ্চলীয় তিনটি নদ-নদী অর্থাৎ সিন্ধু, ঝিলম এবং চন্দ্রভাগার নিয়ন্ত্রণ। বলা হইয়া থাকে, পশ্চিম অংশের এ তিনটি নদ-নদীর মাধ্যমে পাকিস্তানে মোট জলের প্রায় আশি ভাগ প্রবাহ নামিয়া থাকে। চুক্তি অনুযায়ী পাকিস্তান সত্তর ভাগ আর ভারত ত্রিশ ভাগ জলের ভাগীদার। ভারত পূর্বাঞ্চলীয় নদীগুলির জল জলবিদ্যুৎ উৎপাদন ও সীমিত সেচের কারণে ব্যবহার করিতে পারিবে। তবে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ সংরক্ষণ বা পরিবর্তন করিয়া নিম্নগামী এলাকায় জল প্রবাহে বাধা সৃষ্টি করিতে পারিবে না। এই বিধিনিষেধ এবং শর্তগুলি সকলই খুব স্পষ্ট ও কার্যকর, যাহা ইঞ্জিনীয়ারিং ডিজাইনের মাধ্যমে নিশ্চিত করা হয়। পাকিস্তানের জন্য এই কাঠামো কেবল জল নহে, বরং সেচ ও জল সরবরাহ ব্যবস্থাপনা ব্যবস্থা গড়িবার জন্য নিশ্চয়তা দেয়।
সেই দিক হইতে সিন্ধু জল চুক্তি ভারত ও পাকিস্তানের পারস্পরিক সহযোগিতা ও বিরোধ নিষ্পত্তির উদ্দেশ্যে একটি স্থায়ী ব্যবস্থার আয়োজন হইয়া সামনে আসিয়াছিল। চুক্তির পর একটি স্থায়ী ‘সিন্ধু কমিশন’ তৈয়ার করা হইয়াছিল। দুই দেশের একজন করিয়া কমিশনার নিযুক্ত করা হইয়াছিল।তাহাদের দায়িত্ব ছিল তথ্য বিনিময়,নতুন প্রকল্প পর্যালোচনা এবং নিয়মিতভাবে দুই দেশের মধ্যে বৈঠকের আয়োজন করা। চুক্তি অনুযায়ী ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সিন্ধু ও অন্যান্য নদীর পানি লইয়া বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য একটি প্রক্রিয়া অনুসরণ করিত এই কমিশন। প্রযুক্তিগত কোনও প্রশ্ন প্রথমে কমিশনে পাঠাইয়া দেওয়া হইতো। যদি সমাধান না হয়, তাহা হইলে একজন নিরপেক্ষ বিশেষজ্ঞের নিকট পাঠাইয়া দেওয়া হয়। আইনি বিরোধের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালতে পাঠানো যাইতে পারে, বিশ্বব্যাংক উভয় ফোরামে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করিবে।
কিন্তু সত্যই কি জলযুদ্ধ শুরু হইয়াছে পাকিস্তানের কথামতো? দিল্লীতে দীর্ঘদিন ধরিয়া আন্ত:নদী সম্পর্ক লইয়া কাজ করিতেছেন কাউন্সিল ফর সোশ্যাল ডেভেলপমেন্টের পরিচালক ড. নিত্যানন্দ। ড. নিত্যানন্দের মতে, ভারত উত্তেজনার বশে সিন্ধু জলচুক্তি স্থগিতের ঘোষণা দিয়াছে। অতীতে ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের একাধিক যুদ্ধ হইয়াছে কিন্তু সিন্ধু নদের জলচুক্তি বাতিল বা স্থগিতের ঘোষণা নাই। এইবারও জলচুক্তি স্থগিতের ঘোষণা কার্যকর না-ও হইতে পারে। জলচুক্তি স্থগিত করা যুদ্ধ ঘোষণার শামিল নহে। এই ক্ষেত্রে পাকিস্তান আন্তর্জাতিক আদালতে যাইতে পারে, তবে যুদ্ধ ঘোষণা পথ নহে। আন্তর্জাতিক আদালতের রায় ভারত মানে নাই, এই রকম ঘটনার নজির আজ পর্যন্ত নাই।

Dainik Digital

Dainik Digital

Leave a Reply

Your email address will not be published.