সুভাষ ও হিন্দুত্ব!!

 সুভাষ ও হিন্দুত্ব!!
এই খবর শেয়ার করুন (Share this news)

অনলাইন প্রতিনিধি :-রামমন্দিরের উদ্ধোধনের পরদিন ছিল নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর ১২৬তম জন্মজয়ন্তী।সেদিন কলকাতার উওকন্ঠে ‘হে মহাপ্রাণ লহ প্রণাম’ কর্মসূচিতে যোগ দিতে এসে সরসংঘচালক মোহন ভাগবত নেতাজী বন্দনায় মুখর হয়েছিলেন।দাবি করেন, সুভাষচন্দ্রের চিন্তাধারার সঙ্গে সংঘের চিন্তাধারার কোনও পার্থক্য নেই।সেই সঙ্গে সুভাষের জীবন আদর্শ,তার কর্ম, ত্যাগ ও দেশপ্রেমের অনুপ্রেরণা নিয়ে সবাইকে চলার কথা বলেন তিনি। মন্তব্য করেন,নেতাজীর প্রেরণার প্রবাহ আজও চলছে।সংঘ সেই প্রেরণায় কাজ করছে।তিনি আরও বলেন,ভারত গড়ার ক্ষেত্রে নেতাজীর স্বপ্ন এখনও অধরা রয়েছে।তা আমাদেরই পূরণ করতে হবে। সেই সঙ্গে যোগ করেন,নেতাজীর বৈশিষ্ট্য তার উগ্র দেশভক্তি।তার মন্ত্র ছিল, আমার অহঙ্কার,আমার স্বার্থ, আমার কল্যাণ নয়।দেশের কল্যাণেই আমার কল্যাণ। সংঘপ্রধানের মুখে নেতাজী সম্পর্কে এমন বন্দনা শুনে বঙ্কিমচন্দ্রের ভাষা ধার করে বলতে হয়,রাজনীতি এসে ইতিহাসকে নিয়ে গেল।গত দুই বছর ধরে সুভাষ চন্দ্র বসুকে নিয়ে রাজনীতির যে চাটুতে রুটি সেঁকা হচ্ছে,তাতে ইতিহাসের তিলমাত্র নেই। নেতাজীকে নিয়ে বাঙালির প্রভৃত গর্ব।স্বাধীনতা হোক বা প্রজাতন্ত্র দিবস,মাল্যশোভিত নেতাজীর ছবি ছাড়া জাতীয় পতাকা উত্তোলনের দৃশ্য বঙ্গ জীবনে বিরল।কিন্তু সেই গর্বকে মূলধন করে যদি ভ্রান্ত রাজনীতির বেসাতি শুরু হয়, যদি কূট রাজনীতির দৃশ্যপট তৈরি হয়,দুঃখের সঙ্গে বলার, সেটি অন্যায়।দুর্ভাগ্যজনক। নেতাজী সুভাষ কি হিন্দুত্বের প্রতীক হতে পারেন?কলকাতায় ৩৮/২এলগিন রোডের (অধুনা লালপত রায় রোড)সুভাষের বাড়িতে প্রবেশের মুখে তিনটি স্তম্ভ রয়েছে।একটি স্তম্ভের তলায় লেখা ‘ইতমাদ’,মাঝের স্তম্ভের তলায় ‘ইত্তেফাক’এবং শেষ স্তম্ভে লেখা ‘কুরবানি’।বাংলায় এই তিন শব্দের অর্থ ঐক্য, বিশ্বাস এবং আত্মত্যাগ।এই তিনটি শব্দই ছিল আজাদ হিন্দ বাহিনীর এগিয়ে চলার মূলমন্ত্র।আর তাদের উর্দির উপর ‘ইনসিগনিয়া’ বা পরিচয়চিহ্ন ছিল টিপু সুলতানের বাঘ।সাভারকরের হিন্দু মহাসভা সম্পর্কে ১৯৪৩ সালে টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ভারতের মৌলিক সমস্যা’ শীর্ষক প্রদত্ত ভাষণে সুভাষ বলেছিলেন,হিন্দু মহাসভা ও মুসলিম লীগকে ব্রিটিশরাই মদত দেয়।কারণ,তারা নীতিগতভাবে ব্রিটিশপন্থী। প্রশ্ন উঠতে পারে,তবু কেন নেতাজী বন্দনা?সম্ভবত দুটি কারণে সুভাষকে সামনে নিয়ে এসে শাসক গোষ্ঠী লাভবান হতে চায়।প্রথমত,অনস্বীকার্য যে নেতাজী বঙ্গ জীবনে যতই বন্দিত হোন,অবশিষ্ট ভারতের মানসলোকে তার উপস্থিতি খানিক প্রান্তিক।নেহরু পরিবারের ছত্রতলে কংগ্রেস চেষ্টা করে গেছে নেতাজীকে গৌণ চরিত্ররূপেই দেখবার। সুতরাং কংগ্রেস বিরোধিতার রাজনীতিতে নেতাজীর দাম অনেক।দ্বিতীয়ত,নেতাজীর আইএনএস-কেও যোগ্য মর্যাদা দেয়নি স্বাধীন ভারতের সরকারী ইতিহাস।আজাদ হিন্দ ফৌজের আত্মত্যাগের বিবরণ মোটের উপর অবাঙালিদের কাছে অপরিচিত।হয়তো সেই কারণেই পরিকল্পিতভাবে সুভাষ চন্দ্র বসুকে কংগ্রেস বিরোধী শক্তি হিসাবে, সামরিক নেতা হিসাবে, এমনকী ‘হিন্দু কুলতিলক’ হিসাবে নবপ্রতিষ্ঠা দানের প্রয়াস।অথচ এই সমীকরণের বাইরে গিয়ে ইতিহাসকে তথ্যনিষ্ঠভাবে জানতে হলে নেতাজী বিষয়ে প্রধান তথ্যসমূহ যা দাঁড়ায় তার নির্যাস,সামরিক রাজনীতি ছিল তার এক দৃঢ় আদর্শে অন্বিত।বিদেশি শক্তির থেকে স্বাধীনতা ছিনিয়ে নেওয়া, দেশে ধর্মনিরপেক্ষতা শক্তভাবে প্রোথিত করা, প্রয়োজনে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিশেষ সুরক্ষা দেওয়া, সমাজতন্ত্রের পথে দেশকে চালনা করা, কোনও সঙ্কীর্ণতাকে প্রশ্রয় না দিয়ে দেশের বহুসংস্কৃতিকে প্রাণবান করে তোলার আদর্শ। সঙ্কীর্ণ হিন্দুত্ববাদী নেতাদের সঙ্গে তার ছিল স্পষ্ট বিরোধ। গান্ধীজীর পথ তিনি মানতেন না এটা যেমন সত্য,তেমনই সত্য সাভারকরের পথে ছিল তার তীব্র বিদ্বেষ।নেতাজী যখন ব্রিটিশ শাসকের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছেন,তখন ১৯৪১ সালে ভাগলপুর হিন্দু মহাসভার ২৩তম সম্মেলনে সাভারকার নির্দ্বিধায় হিন্দুদের দলে দলে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছেন। তারই উদ্যোগে সে সময় প্রায় এক লক্ষ হিন্দু ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেয় এবং পরবর্তীকালে তারা পূর্বোত্তর থেকে গ্রেপ্তার হওয়া আজাদ হিন্দ ফৌজের সেনানীদের বিরুদ্ধে নৃশংস আচরণ করে।এরপরেও কেউ কষ্টকল্পনায় সুভাষকে হিন্দুত্বের পূজারী ভাবতে ইচ্ছা করলে সেটি একান্তই তার ব্যক্তিগত স্বাধীনতার প্রশ্ন, কিন্তু এর সঙ্গে সত্য বা বাস্তবের কোনও সম্পর্ক নেই।

Dainik Digital

Dainik Digital

Leave a Reply

Your email address will not be published.