স্বস্তির প্রলেপ চাই

বৃস্পতিবার সন্ধ্যায় রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু মণিপুরের দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। ভারতীয় সংবিধানের ৩৫৬ অনুচ্ছেদের ভিত্তিতেই মণিপুরে এই রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করা হয়েছে। মাত্র চারদিন আগে রবিবার এন বীরেন সিং মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব থেকে ইস্তফা দেন। এরপর গত ৪ দিনে বীরেন সিং-এর উত্তরসূরি খোঁজার জন্য বহু চেষ্টাচরিত্র করেও বিজেপি নতুন মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচন করতে পারেনি। অগত্যা মণিপুরে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করার পথেই হেঁটেছে কেন্দ্র।
রাষ্ট্রপতি শাসন জারির ঘোষণাপত্রে অবশ্য প্রথাগতভাবেই বলা হয়েছে, মণিপুরের সাংবিধানিক যন্ত্র ভেঙে পড়েছে, যাতে করে ভারতের সংবিধানের বিধান অনুসারে রাজ্য সরকার পরিচালনা করা বর্তমানে সম্ভব হচ্ছে না। কার্যত কোন রাজ্যে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করার যে প্রাথমিক কারণ থাকে, এই ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে কার্যত তাকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে এবং মান্যতা দেওয়া হয়েছে। মণিপুরে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করে কার্যত সেই রাজ্যে বিজেপির
অকার্যকর শাসন ব্যবস্থা ও ব্যর্থতাকেই প্রমাণ করেছে। যদিও গত দীর্ঘ দুই বছর ধরে জাতিগত সংঘাত, হানাহানি, সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্পে জড়িয়ে মণিপুরে সরকারী তথ্যেই ৩০০ জনেরও বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন এবং ৭০ হাজারের মতো মানুষের সহায় সম্পদ নষ্ট হওয়ায়, তারা বাসস্থান ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছে। ঘটনা হলো, টানা দুই বছর ধরে একটি রাজ্যে নৈরাজ্য, ভেঙে পড়া আইনশৃঙ্খলা, লাগামহীন সন্ত্রাস, সেনা-আধা সেনা থেকে শুরু করে পুলিশ চৌকি ও অস্ত্রাগার লুটপাট, গৃহদাহ কোনও কিছুই বাদ যায়নি। অথচ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক সব কিছু নির্বিবাদে হজম করে গেছে। ভারতীয় সংবিধানের ১৭৪ নম্বর অনুচ্ছেদে একথা বলা আছে। কোন আইনকক্ষ অর্থাৎ বিধানসভার অধিবেশন একটি নির্দিষ্ট সময় অন্তর আহ্বান করতে হয়। অর্থাৎ কোন একটি অধিবেশন যেদিন শেষ হয়েছে এর অন্তত ৬ মাস সময়সীমার মধ্যে পরবর্তী অধিবেশন অবশ্যই আহ্বান করতে হবে। সেই নিরিখে ১২ ফেব্রুয়ারী থেকে বাজেট অধিবেশ শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু অধিবেশন শুরুর পূর্বসন্ধ্যায় রাজ্যপাল এ কে ভাল্লার কাছে আচমকা বীরেন সিং পদত্যাগপত্র জমা দিতে দেন। রাজনৈতিক গুঞ্জন হলো, অধিবেশনে সরকারের বিরুদ্ধে অনা-প্রস্তাবের প্রস্তুতি চলছিল এবং তাতে বীরেন সিং সরকারের পতন সুনিশ্চিত ছিল। যে কারণে রাজ্যপাল পদত্যাগপত্র গ্রহণের পরই ঘোষণা করেন। রাজ্যপালের এই সিদ্ধান্ত সম্পর্কে বিতর্কের অবকাশ আছে। মণিপুর নিয়ে অবশ্য চমকের এখানেই শেষ নয়।
বীরেন সিং-যএর বিকল্প খুঁজতে গত ৩ দিনে বহু চেষ্টা করেও বিজেপির অন্দরে ঐকমত্য অধরা রয়ে যায়। এদিকে সংঘাত বিধ্বস্ত মণিপুরে শেষ বিধানসভা অধিবেশন বসেছিল ১২ আগষ্ট। ৬ মাসের
সময়সীমা হিসাব করলে ১৩ ফেব্রুয়ারী মণিপুরে বিধানসভা অধিবেশন
বাধ্যতামূলক ছিল। কিন্তু বীরেন সিংয়ের উত্তরসূরি হিসাবে বিজেপি সর্বসম্মত প্রার্থী নির্বাচন করতে ব্যর্থ হওয়ায় রাজ্যপাল সামনে সংকট কাটিয়ে ওঠার জন্য তিনটি সম্ভাব্য বিকল্প খোলা ছিল। এক, রাষ্ট্রপতি শাসন, দুইযদি কোনও ঐকমত্য তৈরি না হয় তবে বিধানসভা ভেঙে না বা জিইয়ে রাখলেন। কারণ মণিপুরে বিধানসভা ভেঙে দেওয়া হয়নি। বরং স্থগিত অবস্থায় রাখা হয়েছে। এর ফলে বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব মণিপুরে দলের নেতৃত্ব
সংকট সমাধানের জন্য এবং আগামী কিছুদিন বাদে বিধানসভা পুনরুজ্জীবনের পথ প্রশস্ত করার জন্য হাতে বেশকিছু সময় পেয়ে
গেল। কারণ আপাতত ছয় মাসের জন্যই সেখানে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করা হয়েছে। প্রয়োজনে অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে এর মেয়াদ বাড়ানো যেতে পারে। কারণ ২০২৭ সালের প্রথম দিকে মণিপুর বিধানসভার নির্বাচনের সময়সীমা ধার্য আছে। ৬০ সদস্যের মণিপুর
বিধানসভায় বিজেপি সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলেও অভ্যন্তরীণ গোষ্ঠী
রাজনীতির কারণে শাসক দল বিপর্যস্ত। এর উপর বিগত দুই বছরের রক্তাক্ত হানাহানি, নিষিদ্ধ সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলির দাপাদাপি ও অপকর্ম যে পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছে, তাতে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করে সাংবিধানিক সংকট এড়ানো গেলেও, মণিপুরের জনগণের মধ্যে জাতিগত বিভাজন যে কঠিন সংকট তৈরি করেছে এর প্রতিষেধক যে এখনও সরকারের হাতে নেই, সাম্প্রতিক ঘটনাক্রম ও পরবর্তী পদক্ষেপ যেন সে কথাই বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছে। মণিপুরের সামাজিক কাঠামো গত ২০ মাসে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর কেন্দ্রীয় সরকারের এই পদক্ষেপ মণিপুরের ক্ষতে আদৌ প্রলেপ দিতে পারবে কিনা আগামী দিনেই এর জবাব মিলবে।