স্বাধীনতা ও পথচলা

 স্বাধীনতা ও পথচলা
এই খবর শেয়ার করুন (Share this news)

স্বাধীনতা শব্দখানার গভীরতা জীবনে বিশাল। এই জীবন জীবজগতের যেকোনো কারও হইতে পারে । আর মানুষ যেহেতু সমাজবদ্ধ জীব , তাই তাহার জীবনে স্বাধীনতা শব্দের গভীরতা , বিশাল সীমাহীন । তাহার পক্ষে পরাধীন থাকা যেমন সম্ভব তেমনি সমাজ বা ব্যক্তির জন্য তাহার আবার দায় থাকিয়া যায় । ব্যক্তিজীবনের স্বাধীনতার পরিসর সমাজজীবনে আসিয়া অন্য চেহারা পায় । মানুষের স্বাধীনতা , স্বাধীনসত্তাকে অক্ষুণ্ণ রাখিতে রাষ্ট্র , জাতিরাষ্ট্রের মতন ধারনাগুলি জন্ম লইয়াছে । আজ স্বাধীন ভারতের বর্ষপূর্তি । দুইশত বৎসরের পরাধীনতার শৃঙ্খল ছিন্ন করিয়া ভারতদেশ স্বাধীনতা অর্জন করিয়াছে । সেই অর্জনের বয়স আজ ৭৫ ছাড়াইয়া ৭৬ বৎসরে পা দিতেছে ।

এই সময়ে ভারতবাসী প্রতিজনের হৃদয় আন্দোলিত , উদ্দীপিত । সেই সুদূর অতীত হইতে বর্তমান অবধি এক পদচারণা চলিতেছে মনে মনে । স্বাধীনতা একদিনে , এক বৎসরে কিংবা এক যুগের লড়াইয়ে আসে নাই । ১৭৫৬ সালে পলাশির যুদ্ধে এই মাটিতে ব্রিটিশদের বিজয় সূচিত হইবার পর হইতেই পরাধীনতা সূচিত হয় । বাংলার ভাগ্যাকাশে দুর্যোগের যে ঘনঘটা দেখা দিয়াছিল তাহা ক্রমে ক্রমে সমগ্র ভারতভূমিকে গ্রস্ত করিয়া ফেলে । পলাশি যুদ্ধের ১০০ বৎসর পর ব্রিটিশের বিরুদ্ধে প্রথম সংগঠিত বিদ্রোহ দেখা গেল সিপাহি বিদ্রোহে । মঙ্গল পাণ্ডের প্রদর্শিত পথ প্রাথমিকভাবে কানাগলি প্রতিপন্ন বলিয়া মনে করা হইলেও পথ খুঁজিয়াছেন মানুষ সেই পথেই ।

ব্রিটিশের কারাগার , তাহার দমনপীড়ন , নির্যাতন , শোষণ সকলই পদদলিত করিয়া আগাইয়া গিয়াছিল স্বাধীনতার আন্দোলন । ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহের সূচনা ১৮৫৮ সালে গণ অভ্যুত্থান নামের পরিচিতি পাইয়াছিল ।ওই সময় হইতে ১৯৪৭ সাল , মানে নব্বই বৎসর ধরিয়া এই দেশের সচেতন মানুষ আর বীর সন্তানেরা যে লড়াই করিয়া গিয়াছেন ব্রিটিশ শাসকের বিরুদ্ধে যাহাকে আমরা অগ্নিযুগ হিসাবে চিনি । পঁচাত্তরতম স্বাধীনতার বর্ষপূতিতে মানুষ সেই সকল বীর সেনানীদিগের আত্মত্যাগ স্মরণ করিতেছেন , আবার অজানা , অনামী হাজার লক্ষ মানুষ যাহারা আত্মত্যাগ আর বুকের রক্তে শাসকের পাষাণ বেদিকে নাড়াইয়া দিয়াছিলেন তাহাদের প্রতি জানাইতেছেন শ্রদ্ধা

যাহাদের তিতিক্ষা আর চরম আত্মত্যাগেই আসিয়াছে স্বাধীনতা , তাহাদের প্রতি স্মরণাঞ্জলি আর স্মৃতিচারণ ছাড়া এইদিনের সকল উৎসব , রাজসূয় যজ্ঞ অর্থহীন হইয়া যায় । এই কথা অন্তত ব্যক্তির পরিসরে সকলেই প্রশ্নাতীত বলিয়া মনে করিয়া থাকেন । ১৯৪৭ সালের মধ্যরাতে স্বাধীনতা আসিল অবশেষে , তাহা লইয়া উদ্দীপিত হইয়াছিলেন প্রতিটি ভারতবাসী । প্রতিটি গৃহে প্রদীপ জ্বলিয়াছিল । সেই প্রদীপের সলিতা পাকানো শুরু হইয়াছিল ৯০ কিংবা ১০০ বৎসর পূর্বে । স্বাধীনোত্তর ভারত লইয়া আমাদের স্বাধীনতার যোদ্ধারা কি ভাবিতেন , কেমন হইবে তাঁহাদের স্বাধীন ভারত ? সকলেই চাহিতেন ভারত হইবে স্বাধীন রাষ্ট্র ।

স্বরাজ আসিলে ভারতের শাসক হইবেন ভারতবাসী । ভিন দেশের কোনও মানুষ নহে । ভারত জনচিত্ত হইবে সৌভ্রাতৃত্বের মাধুর্যে পরিপূর্ণ এবং ঐক্যবদ্ধ । ঐক্যবদ্ধ থাকিবার আকাঙ্ক্ষা তাহাদের ছিল কারণ অনৈক্য পরাধীন ভারতেও ছিল । দেশের প্রাকৃতিক বৈচিত্রের মতনই নাগরিকদের বিবিধতা , বিরুদ্ধতা ছিল । কিন্তু অসম সত্তার মধ্যেই বিদেশি শাসকদিগকে উৎখাতের কল্পে সকল বিভিন্নতা এক সময়ে এক অভিন্নতায় চলিয়া আসে । তাহারা জন্মভূমিকে বিদেশের শৃঙ্খল হইতে মুক্ত করিবার জন্য প্রত্যেকেই স্বপ্ন দেখিয়াছেন । সেই সকল স্বপ্নের চিত্রপট ভিন্ন ভিন্ন হইলেও গন্তব্য ছিল একটাই । তাই কেহবা শস্ত্ৰ লইয়া পথে নামিলেন , কেহ নামিলেন । নিরস্ত্র ও অহিংসার মন্ত্রে

তাহাদের পথ চলায় বিভিন্নতা কিংবা মতবিরোধ থাকিলেও গন্তব্য ছিল একটাই । এই অভিন্নতাই দেশকে স্বাধীনতা অর্জনের দিকে দ্রুত আগাইয়া লইয়া যায় । আজিকের দিনে সেই বিশাল কাল আর আরও সুবিশাল কর্মকাণ্ড লইয়া কথা বলা অসম্ভব , আবার স্বাধীনোত্তর ভারতে গত ৭৫ বৎসরে আমাদের কতটা স্বপ্নপূরণ হইয়াছে তাহার হিসাবও সম্ভব নহে । কারণ এই সময়কালে রাজনৈতিক , সামাজিক , কূটনৈতিক , সাংস্কৃতিক বহুমুখীতায় পথ চলিতে হইয়াছে । দেশ জুড়িয়া যখন ৭৫ বৎসর পূর্তির অমৃতের উৎসব চলিতেছে তখনও দেশের সরকার আবাসন প্রকল্পগুলি দ্রুত বাস্তবায়নের কথা বলিতেছে সকল রাজ্যগুলিকে ।

অর্থাৎ দেশের একটা বৃহৎ অংশের মানুষ আজও মাথা গুঁজিবার ছাদ খুঁজিয়া পায় নাই । পায় নাই দুইবেলার অন্ন , লাজ ঢাকিবার জন্য প্রয়োজনীয় বস্ত্র । এই কঠোর সত্য আমাদের রাষ্ট্রজীবনে এক কন্ঠকিত অস্বস্তি । ইহাকে বুকে গাঁথিয়াই উৎসবে শামিল হইতেছি আমরা । কারণ স্বাধীনতার উদযাপন ছাড়া তো আগামীর পথ চলাও সম্ভব নহে । অতীতকে ভুলিয়া কেবল উচ্ছ্বাসে গা ভাসাইলে যেমন বেপথু হইয়া যাইবার আশঙ্কা থাকে তেমনি অন্ন , আগামীর অবশ্যকরণীয় বিষয়গুলিও মনে রাখিতে হয় । আজও বস্ত্র , বাসস্থান , জনস্বাস্থ্য আমাদের রাষ্ট্রজীবনে প্রথম অগ্রাধিকার ক্ষেত্র ।

Dainik Digital

Dainik Digital

Leave a Reply

Your email address will not be published.