স্বাস্থ্যচিন্তায় বিপন্ন পরম্পরার পান।
অনলাইন প্রতিনিধি || পান চাষ ক্রমে সরকারী নিষেধাজ্ঞার সীমানায় চলে যাচ্ছে।বলা হয়ে থাকে যেহেতু পানের সঙ্গে জর্দার যোগাযোগ সেই কারণে পান চাষকে নিরুৎসাহ করা হচ্ছে। ত্রিপুরায় পান (বিটল লিফ) সরকারের ঘরের রেস্ট্রিকটেড হলেও সুপারির (বিটল নাট) চারা বিলি চলছে ঠিকঠাক।অর্থকরী ফসল হিসাবে রাবারের একচেটিয়া চাষের বিপক্ষে সুপারি বাগান হচ্ছে।বস্তুত দক্ষিণ জেলাতেই পানচাষিদের অবস্থান, ত্রিপুরার পান প্রতিবেশী আসাম, মিজোরামের বাজারে কদর পায় ৷ কিন্তু গত বছর সাতেক ধরে পানচাষিদের পাশে নেই সরকার। আর দুই বছর ধরে পান বরজে এমজিএন রেগার কাজও নিষিদ্ধ হয়ে গেছে।খরা,সরকারী অসহায়তার মুখে বিকল্প চাষের পথও খুঁজে পাচ্ছেন না রাজনগর ব্লক এলাকার হাজার পানচাষি। রাজনগরে পানের বাজার বসে সপ্তাহে দুইদিন, মঙ্গল ও শনিবার ভোর চারটায়। রাধানগর বাজারের বিদ্যুৎহীন শেডঘরে এর আগে থেকেই গিজগিজে ভিড় ছিল ক্রেতার।এরা প্রায় সবাই উদয়পুর, তুলামুড়া থেকেই এসে থাকেন। বাঁশের খাঁচি করে পান নিয়ে আসছিলেন রাধানগর, রাঙ্গামুড়ার চাষি পুরুষ, মহিলারা। এই দুইটি গ্রাম ছাড়াও কিছু কিছু পান চাষ হয় ডিমাতলিতে। এখানকার পানচাষি যারা এরা প্রায় সবাই এসেছেন চট্টগ্রাম থেকে। প্রথমে নিজেদের প্রয়োজনে পান চাষ শুরু করেন। পান যেহেতু জুড়ে আছে খাদ্যাভ্যাসে, আচারে- উপাসনায় আর সংস্কৃতিতে তাই পান চাষ ছিল জরুরি। সত্তরের দশকের শুরুতে এই চাষের সাফল্য বাণিজ্যিক চাষকে উৎসাহিত করে। ইদানিং গাবতলি এলাকায় ছড়েছে পানচাষ।কয়েক ঘর উপজাতি পরিবারও টিলার গায়ে পান চাষ শুরু করেছে।বাঙালির বিয়েতে মাছ ও পান ছাড়া যাত্রা হয় না, একথা বলা হয়ে থাকে। বাংলার মঙ্গলকাব্যেই যে শুধু পানের উল্লেখ রয়েছে এমন নয়। পানের ওষুধি গুণের বর্ণনা তো চরক থেকে সুশ্ৰুত সর্বত্র পান নিয়ে উচ্ছ্বাসই প্রকাশ করা হয়েছে। সুশ্রুতের লেখায় পানের ভোগবিলাসী রূপের বর্ণনাও আছে। গুরু ভোজনকারীদের উদ্দেশ্যে পইপই করে বলা হয়েছে, আহার শেষে তারা যেন অবশ্যই কর্পূর, জায়ফল, লবঙ্গ সহযোগে পান মুখে দেন। সংস্কৃত সাহিত্যের বঙ্গানুবাদে বহু জায়গায় পঞ্চ সুগন্ধী সহ পান খাওয়ার কথা বলা আছে। আধুনিক সময়ে পান খাওয়াকে বদভ্যাস বলা হলেও আয়ুর্বেদে সপ্তশিরা পানকে হজমে সহায়ক, মুখের স্বাস্থ্য, দুর্গন্ধ দূরীকরণে সহায়ক, মাড়ির ফোলা কমানোয় প্রয়োজনীয় বলা হয়ে থাকে।মধু মিশিয়ে পান সর্দি-কাশিতে,মাথা ব্যথায় উপকারী বলা হয়ে থাকে। এছাড়াও রয়েছে এর অজস্র গুণের বিবরণ। কিন্তু পান খাওয়া শহুরে লোকদের কাছে একটি ধিকৃত বিষয়,কারণ পানের পিক সুদৃশ্য দেওয়াল, পথঘাটকে নোংরা করে থাকে।আধুনিক চিকিৎসায় চিকিৎসকেরা পান খাওয়া বারণ করে থাকেন। দেশের সিংহভাগ মানুষ গ্রামে থাকেন এবং তারাই উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত। তাদের অভ্যাস, সংস্কৃতি, ব্যবসা, কৃষির কথা কি ভাবা হবে না সরকারী নীতি নির্ধারণে? দক্ষিণের ঋষ্যমুখ, নলুয়া সহ বিলোনীয়া মহকুমার অন্যান্য প্রান্তের মতো রাজনগরে সমতল জমিতে পানের চাষ নেই। সমতল জমির অভাবই হয়তো এর বড় কারণ। এখানে পানের বরজগুলি অধিকাংশই সংরক্ষিত বনাঞ্চলে, টিলা এলাকায়। ফলে সেচের সমস্যা তাদের জন্মলগ্ন থেকে। বন দপ্তর বনভূমিতে পান চাষে বাধা দেয় না। আবার সেই জমিতে তারা পাট্টাও পান না । কারণ বনভূমিতে পাট্টা পেয়েছেন শুধু বনবাসী, উপজাতিরা। দত্ত, ঘোষ, দে ইত্যাদি পদবির এই মানুষগুলি দশকের পর দশক ধরে বনবাসী হয়েও তারা যেহেতু জেনারেল ক্যাটাগরির মানুষ তাই তারা পান বরজের জমিতে স্থায়ী জলের উৎস বানাতে পারেন না। এই অভিযোগ পানচাষি ও বিক্রেতা রাধানগরের রতন দে-র। মঙ্গলবার ভোর পাঁচটার মধ্যেই হাটের অধিকাংশ পান বেচাকেনা শেষ। ছোট ছোট ট্রাকগুলি দ্রুত বেরিয়ে আসছিল হাট থেকে। শেডঘরের পাশেই ছয়টি গদি বা আড়তদারের ঘর।এখানে কোনও আড়তই ব্যক্তি মালিকানায় নয়। একেকটি আড়ত উৎপাদকদের সমবায়। আড়ত প্রতি হাজার টাকা বিক্রিতে ১০০ টাকা পায় সংশ্লিষ্ট আড়তের সদস্য চাষির কাছ থেকে। কেমন ছিল আজকের দর? প্রশ্নের জবাবে আড়তের গদিতে বসা সঞ্জয় দে জানান, সর্বোচ্চ দর ছিল ৯০ টাকা বিরা (৮০টি পাতা)। জানা গেল পানের বরজে বছরে তিন সময়ে বেশি পান কাটা হয় অর্থাৎ উৎপাদন হয়ে থাকে। আষাঢ় মাস, কার্তিক মাস আর ফাল্গুন মাস। কার্তিকের পান থাকে উৎকৃষ্ট আর আষাঢ়ে নিকৃষ্ট। যদিও আষাঢ়েই ফলন হবে বেশি। সেই হিসাবে এই সময়ে রাধানগর পানের হাটেও প্রতি বিরার দাম সর্বোচ্চ ২০/৩০ টাকাই হতো। হয়নি,কারণ খরা। সঞ্জয় দে জানালেন, খরায় ৮০ ভাগ ফলন নষ্ট হয়ে গেছে এই বছর। সপ্তাহে দুইদিন হাট বসে। জানা গেল, রাধানগরের হাটে একদিনে বেচাকেনার পরিমাণ থাকে ১০ লক্ষ থেকে ১৫ লক্ষ টাকা। তাহলে তো পান চাষিদের রোজগার ভালোই বলা যায়। এই মন্তব্যের প্রতিবাদ জানালেন চাষি রবি চরণ দে। বললেন, মজুরি বেড়ে গেছে। পাঁচশ টাকা রোজ। এর বাইরে নিয়ম হয়ে গেছে পান বরজে যারা কাজ করবে তাদের ভাত খাওয়াতে হয়। বছরে দুইবার গোবর, খইল দিতে হয়। জলসেচ তো আছেই। আগে সরকারী সহযোগিতা পাওয়া যেত নানা স্কিমে। এখন কিছুই মেলে না ৷ এই খরায় খেত নষ্ট হয়েছে, কোনও সহায়তা নেই কোনও তরফে। সঞ্জয় দে জানালেন, আমরা যে জমিতে চাষ করি সেই জমি ফরেস্টের। পানচাষিরা গত বছর ডেপুটেশন দিয়েছিলাম বরজের জন্য এক / দেড় কানি জমি চেয়ে। দেয়নি। প্রসঙ্গত, পান চাষের প্রতি কেন্দ্রীয় সরকারের দুয়োরানি মনোভাব প্রথম দেখা গেছে ২০১৫-১৬ সালে, স্কিল ডেভেলাপমেন্ট কর্মসূচিতে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সরকারের এই ফ্ল্যাগশিপ
কর্মসূচিতে পান চাষের কোনও প্রশিক্ষণ ছিল না। পান রেস্ট্রিকটেড বলে দাগানো ছিল। এরপরেও দক্ষিণ জেলায় পান চাষে রেগার শ্রমদিবস থাকতো। রাজনগরের কৃষি সুপারিন্টেণ্ডেন্ট শরদিন্দু নারায়ণ দত্ত জানান, দুই বছর আগে পান বরজে রেগা রেস্ট্রিক্টেড হয়।এরপর আমরা পানচাষি নিয়ে আর ভাবিনি। দপ্তর যদি তাদের জন্য স্কিম নিত তাহলে অনেক পানচাষি তো রয়েছে এই অঞ্চলে।হর্টিকালচারের অধিকর্তা ফণীভূষণ জমাতিয়া বলেন, পান চাষ রেস্ট্রিকটেড নয়। কিন্তু স্বাস্থ্য ভাবনা থেকে পান সুপারির উপর কেন্দ্রীয় সরকারের কোনও প্রকল্প নেই। তিনি স্বীকার করেন, বাণিজ্যিক ভাবনা ও স্থানীয় মানুষের চাহিদার কথা ভেবে সুপারি বাগান হচ্ছে ঠিকই কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার পান সুপারিকে উৎসাহিত করে না। কিন্তু পান চাষ কখনোই গাঁজা চাষের মতো নিষিদ্ধ নয়।