স্লোগানই কি সার?
নেশামুক্ত ত্রিপুরা। রাজ্যে বিজেপি জোট সরকার ২০১৮ সালে ক্ষমতায় এসে এই স্লোগানের আমদানি করেছিলো। কিন্তু আজ ছয় বছর পর এই স্লোগান কোথায় দাঁড়িয়ে। নেশামুক্ত ত্রিপুরা তো গড়েইনি বরং নেশার করাল গ্রাসে যুবসমাজ আরও উচ্ছন্নে যেতে বসেছে। প্রশ্ন, তাহলে নেশামুক্ত ত্রিপুরা স্লোগান কি আদতে স্লোগানই থেকে যাবে?এক সময় রাজ্যে নেশা বলতে চোলাই মদ, বিদেশি মদ,গাঁজা, ফেন্সিডিল, কোরেক্স, বিড়ি, সিগারেট ইত্যাদিকেই মনে করা হতো। যুবসমাজ এগুলিকেই নেশা হিসাবে বেছে নিতো।গত দুই আড়াই দশকে গাঁজা ওঠে আসে নেশার প্রথম প্রতিপাদ্য বিষয় হিসাবে। গাঁজাকে এক সময় ত্রিপুরার কুটির শিল্প বলা হতো। তবে ত্রিপুরার সব প্রান্তে গাঁজা চাষ হতো না।গাঁজা ত্রিপুরার কিছু কিছু এলাকাতে চাষ হতো। আজও গাঁজা ত্রিপুরার অন্যতম উৎপাদিত নেশাসামগ্রী। কিন্তু আজকাল কি শুধু গাঁজাই নেশা সামগ্রী হিসাবে ত্রিপুরায় সুবিদিত? এক কথায় উত্তর – না। এখন গাঁজার পাশাপাশি ত্রিপুরায় জায়গা নিয়েছে মাদক অর্থাৎ ড্রাগ।যা শিরাপথে ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে নেওয়া হচ্ছে।এছাড়া ট্যাবলেট, কৌটা ইত্যাদিও ত্রিপুরায় এখন নেশা সেবনকারীদের কাছে অতি সুপরিচিত নাম।এবং এটা অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই যে,গত পাঁচ বছর ধরে এই ধরনের ড্রাগ সেবনকারী,মাদক সেবনকারীর সংখ্যা এ রাজ্যে বেড়েছে।এবং পাড়ায় পাড়ায় নেশা সেবনকারীর সংখ্যা বেড়েছে।এর সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে গাড়ি দুর্ঘটনা, বিভিন্ন অপরাধ, সাইবার অপরাধ। এর পেছনে কোনও না কোনওভাবে নেশা জড়িত।
সরকার ‘নেশামুক্ত ত্রিপুরা’ একটা স্লোগান বাজারে ছেড়েছে। তাতে কি সরকার কিংবা প্রশাসনের কাজ শেষ?
ত্রিপুরায় গত পাঁচ বছরে কী পরিমাণ গাঁজা উদ্ধার হয়েছে? কতজন নেশাকারবারির বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, কতজনকে ধরা হয়েছে এর পরিসংখ্যান দেখলেই বোঝা যাবে যে এ রাজ্যে নেশা কতটা ভয়ঙ্কর
হয়ে ওঠছে। আগে নেশার রাজ্য হিসাবে ভাবলে প্রথমেই মিজোরাম,নাগাল্যাণ্ড, মণিপুর, মেঘালয় এই সমস্ত রাজ্যের কথা চোখের সামনে
ভেসে উঠতো।কিন্তু আজকের ত্রিপুরার চেহারাটা কী?রাজ্যে অপরাধের গ্রাফ ঊর্ধ্বমুখী। শুধু ঊর্ধ্বমুখীই নয়, অপরাধের ধরন পাল্টেছে। যদিও সরকার কিংবা প্রশাসন হয়তো পরিসংখ্যান দিয়ে তা খণ্ডন করবার চেষ্টা করবে। কিন্তু এটা ঘটনা, অপরাধের একটা বড় অংশ এখন নেশা এবং মাদককে ঘিরেই হচ্ছে। ছাত্র, তরুণ, যুবাদের একটা বড় অংশ এ রাজ্যে নেশার করাল থাবায় জর্জরিত। নেশাবিরোধী অভিযানও চলছে। কিন্তু তা চলছে মান্ধাতা আমলের ধরনে। ড্রাগ, মাদক এ রাজ্যে সহজলভ্য হয়ে ওঠেছে সরকার, প্রশাসনের ঔদাসীন্যে। ওষুধের দোকান থেকে সহজেই মাদক, ড্রাগ কিংবা নার্ভজাতীয় ওষুধের স্ট্রিপ চলে আসে যুব সমাজের কাছে।যুবসমাজ নেশায় বুঁদ হয়ে যাচ্ছে। অথচ এই নেশার ওষুধ কিংবা ড্রাগ কীভাবে রাজ্যে আসছে তার হিসাব যাদের রাখার কথা তা করা হচ্ছে না। তদারকি নেই। শিরাপথে যারা ড্রাগ কিংবা নেশা নিচ্ছে তারা বেশিরভাগ কিনছে অনলাইনে।এর কোনও নজরদারি নেই। রাজ্যে শুধু ওষুধের দোকানেই নয়, মুদির দোকানে মুড়িমুড়কির মতো বিকোচ্ছে নেশাজাতীয় ওষুধ।শুধু যা হচ্ছে এই রাজ্যে তাহলো চিরাচরিতভাবে ড্রাগ ইনস্পেকটররা দোকানে গিয়ে মাঝেমধ্যে ভিজিট করছেন। কিন্তু এতে কি কাজের কাজ কিছু হচ্ছে? ফলে ওষুধ ব্যবসায় নেশাসামগ্রীর বাড়বাড়ন্ত কোনও মতেই রোধ করা যাচ্ছে না। কেননা এই নেশাকারবারিদের একটা চক্র রয়েছে।সেই চক্র রাজ্য পেরিয়ে দেশ, দেশ পেরিয়ে বিদেশেও সক্রিয়। এবং তা হচ্ছে সরকারের চোখকে ফাঁকি দিয়ে, প্রশাসনকে ফাঁকি দিয়ে। বাইরে থেকে বিমানে, রেলে, সড়কপথে নেশাসামগ্রী ট্যাক্স ফাঁকি দিয়ে রাজ্যে প্রবেশ করছে। তাহলে তা কীভাবে প্রবেশ করছে?
নেশামুক্ত ত্রিপুরার স্লোগান দিয়ে শুধুই গালভারী প্রচার পাওয়া যায়। নেশামুক্তি সত্যি সত্যি করা কি সম্ভব? একেবারে সম্ভব না হলেও সরকারের সমস্ত বিভাগ, বেসরকারী সংস্থা, সুশীল সমাজ থেকে শুরু করে রাজনৈতিক, অরাজনৈতিক বিভিন্ন সংগঠন— সবার মিলিত প্রয়াস এক্ষেত্রে জরুরি। তাহলেই কিছুটা হলেও নেশার বিরুদ্ধে কিছু করা সম্ভব। আর বড় বড় রাঘববোয়ালদের ছাড় দিয়েও কি তা সম্ভব? এক্ষেত্রে নেশার বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি নিতে হবে সরকারকে।এবং এক্ষেত্রে শুধু কথার কথা নয়, কাজ করে দেখাতে হবে সরকারকে তার পুলিশ প্রশাসনকে। নেশাকারবারিদের বিরুদ্ধে ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টে দ্রুত বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার উপর জোর দিতে হবে সরকারকে।