হেমন্তের হলুদ পাতা

 হেমন্তের হলুদ পাতা
এই খবর শেয়ার করুন (Share this news)

নদীটার দিকে তাকিয়ে ছিল ফুরাদ। তার কতদিনের চেনা নদী। আজও বয়ে চলেছে। আগের মতো তেমন জোর নেই স্রোতে। কেমন যেন মরা মরা। ফুরাদের মন খারাপ হয়ে গেল। কত এই নদীতে ঝাঁপানো। কত সাঁতার কাটা। দুপুর হলেই নদীর কাছে এসে দাঁড়ায়ও। এ সময় হালদার বাড়ির বড় মেয়ে
গন্ধা আসে। এক বুক জলে নেমে কাপড় কাচে। ফুরাদ চুপ করে বসে দেখে। নদীর পাড় ঘেঁষে বকুল গাছটা। অনেক পুরোনো গাছ। কেমন একটা মিষ্টি গন্ধ বাতাসে মিশে ভেসে
আসে। ফুরাদ গন্ধার কাপড় কাচা দেখে। নদীর জল ওকে ছুঁয়ে থাকে। গন্ধার বুক জলে ভেসে থাকে। কেমন এক মাদকতা ছড়ানো। ফুরাদের কেমন নেশা লাগে। নদীর শীতল
বাতাস ওকে জড়িয়ে ধরে। কেমন এক ঝিমুনি ভাব আসে। ওর চোখ এঁটে আসে। বেলা হয়ে যায়। জল মেখে জলজ গন্ধ ছড়িয়ে গন্ধা চলে যায়। বকুল গাছটার ডালের ফাঁকে
একটা পিউ কাঁহা ডাকে। ফুরাদের মনটা কেমন যেন হয়ে যায়। এখন আর বকুল গাছটা নেই। সেবার বন্যার জল পেয়ে মরে যায় গাছটা। কেমন খাঁ খাঁ করছে সব।
কতদিন পর তার আসা। এখন আর হালদার বাড়িতে কে থাকে কে জানে! নিশ্চয়ই এখন আর গন্ধা নেই। সে হয়তো বহু দূর চলে গেছে। ফুরাদ তার কাছাকাছি আসতে চেয়েছিল। কিন্তু সে তার মনের কথা বলতে
পারেনি। এক সময় কাজ নিয়ে ও শহরে চলে যায়। ওর মনের ভেতরে সময়ের পলি জমতে শুরু করে। গন্ধা আস্তে আস্তে মিলিয়ে যায়।
চোরা শ্রাবণ ধুয়ে দেয় মনের তট থেকে তার নাম। আজ আবার সব মনে পড়ে যাচ্ছে একটু একটু করে। নদীর কাছে না এলেই ভাল হতো। বুকের কাছে নদীর ঢেউ লাগতেই
কেমন যেন সব আলগা হয়ে গেল। পুজো কদিন আগেই শেষ হয়েছে। কাঠামোগুলো জলে ভাসছে। ঠিক ওর বুকে যেভাবে কথাগুলো ভেসে আছে। দূরে কাশ বন। এখন আর ফুল নেই। সব ঝরে গেছে। বাতাসে
দুলছে। কেমন যেন সব ফাঁকা। ওর কত কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। এই গ্রামে তার বাল্যবেলা কেটেছে। সব যেন সেদিনের কথা। মধ্যে থেকে কত বছর কেটে গেল। জীবন থেকে
কত-কীই হারিয়ে যায়, টের পাওয়া যায় না। গাছের সবুজ পাতার মতো একদিন সব হলুদ হয়ে আসে। মজু চাচা, কলমী, দীপক এরা কে কোথায় হারিয়ে গেছে। মজুচাচাকে ওর মনে
আছে এখনও। তার আখড়াতে ওদের যাতায়াত ছিল। সব দল বেঁধে যেত, মজুচাচার গান শুনতো। মজুচাচার গলাতে জাদুছিল। একবার গান শুরু করলে আর থামত না। চলত আসর সারা রাত। মানুষটি সকলকে আপন করে নিতে পারত। সেই আখড়া আর
নেই। মজুচাচাও নেই। এত কিছু তার জীবন থেকে হারিয়ে গেছে। এই মরা নদীর মতোই যেন। বুকের কাছটা চিনচিন করে ওঠে। চোখের কোণ জলে ভিজে যায়। ফুরাদের মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। ও গিয়ে বসে একটা চারা বট গাছের নিচে। বট গাছটা খুব বেশি দিনের নয়। বেশ তরতরিয়ে উঠেছে।
গাছের নিচে বসে নিজেকে আলগা করে দেয়। নদীর এক ঝলক তাজা বাতাস এসে ওকে জড়িয়ে ধরে। ওর কেমন একটা ঢুলুনি মতো আসে। এমন সময় হঠাৎ কে যেন ওকে
ডাকে, ফুরাদ, এলি তাহলি! কতদিন আসর হয় না। আয় না গান শুনি। ও হঠাৎ চমকে ওঠে। এ তো মজুচাচার গলা। চারদিকে চেয়ে
দেখে কেউ নেই। ফাঁকা মাঠ। রোদের খেলা। ধানের দোলা। বাতাস যেন হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। ওই দূরে মজুচাচার গলা শোনা যাচ্ছে।
কে যেন বলে ওগো মন মাঝে আছে মন পাখি
কোন ডাকে দেবে সাড়া থাকবি পড়ে দেহ ছাড়া সবই ফাঁকা! ফুরাদ কেমন আনমনা হয়ে
যায়। নদীতে আবার বাতাস উঠেছে। জল টলমল করছে। এ ঢেউ তার মনে এসে লাগে। সব তোলপাড় করে ওঠে। সময় কীভাবে একলা করে দেয়। মানুষের পিছনে ফেলে আসা দিনগুলোর জন্য কষ্ট পায়। ফুরাদও কষ্ট পাচ্ছে। এখানে না এলেই ওর ভাল হতো।
তার শিকড়টা অনেক আগেই আলগা হয়ে গেছে। একে একে সব চলে গেল। শুধু ফুরাদ থেকে গেল। সে শহরে চলে গেলেও তার মন কিন্তু এখানেই পড়ে। যেদিন ওর মা মারা
গেল সেদিন গন্ধা ওর পাশে এসে দাঁড়ায়। ফুরাদের একাকিত্ব অনেকটা কেটে যায়। কেমন ওকে আগলে রেখেছিল। ওর মা থাকতে গন্ধা ওদের বাড়ি আসত। মায়ের সঙ্গে গল্প করত। ফুরাদের ঘরে ঢুকে যেত
অনায়াসে। তার কোনও বাধা ছিল না। সে কারও বাধা মানত না। কী গো ফুরাদদা, ওঠবিনি। তুমি না খুব ফাঁকি মারো। ওঠো।
আঃ! তুই খুব জ্বালাস। যাও আর আসবোনি।
এই এক জ্বালা! একটুতে তুই রেগে যাস।
গন্ধা আর দাঁড়ায় না। ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। বাইরে ওর গলা শোনা যায়। ফুরাদ আর একটু আয়েশ করে শুয়ে থাকে। যেন ওদের বাড়ি ভুল করে পাগল নদী এসে সব ভাসিয়ে দিয়ে গেল। এ নদী সব এলোমেলো করে দিয়ে যায়। কারও বাধা মানে না। ফুরাদ আর একটু বসে থাকে। বেলা হয়ে গেছে। ওর কেমন খিদে পেয়ে যায়। বট গাছের ডালে বসে একটা বুলবুলি ডাকাডাকি করছে। ও
একবার দেখবার চেষ্টা করে। কিন্তু ওকে পাতার আড়ালে দেখা যায় না। নদীতে ছোট ছোট মাছ খেলা করছে। আজ বাতাসে কেমন এক হিম ভাব।
‘দুই’
বেশ ক’দিন ওর এখানে আসা হল। এখন আর আগের মতো গ্রাম নেই। শহরের ছোঁয়া চারপাশে। নিমাই ওকে বলছিল, দেখ ফুরাদ, আগের মতো আর কিছুদেখতে পাবি না।
মাটির বাড়িগুলো একটাও নেই। বিলটাও দখল হয়ে গেল। আমরা কত খেলেছি। ফুল তুলে আনতাম। শাপলা হতো খুব। দেখতে দেখতে সব বদলে গেলরে! নিমাইয়ের গলাটা কেমন ধরে আসে। এমন সময় নিমাইয়ের বউ চা দিয়ে যায়। নিমাই একটা ছোট্ট মুদির দোকান দিয়েছে। চলে যায় কোনও রকমে। নিমাই পড়াশোনাতে ভাল ছিল। অনেকে চাকরি বাকরি পেয়ে চলে গেছে। শুধু তার বন্ধু বলতে এখন নিমাই। ও নিমাইকে ভোলেনি। যদিও সে এখানে আসে কম। গন্ধা
চলে যাবার পর ও আর এখানে ফিরতে চায়নি। সব বাঁধন কেমন আলগা হয়ে গিয়েছিল। এ গ্রামে যেন আর ও নিশ্বাস নিতে পারছিল না। দুম করেই ও চলে যায়। তারপর কত বছর কেটে যায়। গন্ধার খোঁজ আর ও রাখেনি। ওর যখন বিয়ে লাগল তখন একবার
এসেছিল। ফুরাদের ঘরে এসে সব গুছিয়ে দেয়। তুমি খুব এলোমেলো। কিছুটি গুছিয়ে রাখত পারনি। তুমি কী গা? তুই তাহলে চলে যাচ্ছিস? বেশ গম্ভীর শোনায় ফুরাদের গলা। গন্ধা বইগুলো গোছাতে গোছাতে তাকিয়ে
থাকে ফুরাদের দিকে। বাইরে একটা ছাতার ডাকছে। পরিবেশটা কেমন বিষণ্ণ করে তোলে। গন্ধার ঘন মাথার চুলগুলো কেমন আজ এলোমেলো। ও ঠিক গুছিয়ে রাখতে পারেনি। ওর আজ কি শেষ আসা? গন্ধা তাহলে আর ওদের বাড়ি আসবে না? আমি তো যেতে চাইনি। তুমি কি বুঝলে আমাকে?
গন্ধার দু’চোখ জলে চিকচিক করে ওঠে। ও আর কথা বলতে পারে না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। সময় গড়িয়ে যায়। ছাতারটা আজ যেন পাগল হয়ে গেছে। ও থামতে চাইছে না। দূরে এক ফেরিওয়ালা চেঁচাচ্ছে। ফুরাদ খাটে বসে গন্ধাকে দেখছে। ওর মনে হল ওকে বুকে
জড়িয়ে ধরে কাঁদতে। আজ ওর মন ভাল নেই। কী হল ফুরাদ? নিমাই জিজ্ঞেস করে।
ফুরাদ একটু সময় নেয়। তারপর চায়ে একটা চুমুক দেয়। চা-টা কেমন তেতো লাগে। ওর চা খেতে মন করছে না। নিমাই চা শেষ করে একটা বিড়ি এগিয়ে দেয়। ফুরাদ বিড়িটা নেয়। ও বহু দিন আগে ধূমপান ছেড়ে দিয়েছে। তবু আজ ওর খেতে ইচ্ছে হল। বিড়িটা ধরিয়ে ও একটা টান দেয়। তারপর নিমাইকে ও জিজ্ঞেস করে, নিমু, গন্ধার কোনও খবর জানিস? ওর কোনও খবর আমি জানি না। নিমাই বিড়িতে একটা টান দিয়ে বলে, তুই জানিস না কিছু? নারে। ওর ভাগ্যটা খুব খারাপ। যে বছর ওর বিয়ে হল সে বছরই ওর বরের মৃত্যু হয়। ও নাকি খুন
হয়েছিল। রাজনীতি করত শুনেছি। কী ভাগ্য বলত! গন্ধা এখন এখানেই থাকে। ওর বাবাও তারপর মারা যায়। মেয়েটি বড় একা হয়ে যায়। ফুরাদ বিড়িতে টান দিতে ভুলে যায়। ওর মনটা কেমন যেন করছে। ও কি সব ভুল শুনল? ওর মনের ভেতর একটা ধাক্কা খেল। গন্ধাকে দেখার জন্য মনটা কেমন উতলা হয়ে ওঠে। নিমাই আরও কী সব বলে যায়। ওর কানে কিছুঢুকছে না। আজ আবার ছাতার ডাকছে। ওর বুকে কি? কী হল তোর? নিমাই, ওর সঙ্গে কি একবার দেখা করা যায় না? ও তো বাড়ির বাইরে বের হয় না। লোকে নানান কটু কথা বলে বলে বের হয় না। ও নিজেকে
আড়ালে রেখেছে। ফুরাদ আর কথা বাড়ায় না। মুদির দোকানে এক একটা খরিদ্দার
আসছে। নিমাই ওদের মাল দিচ্ছে। ফুরাদ চুপ করে বসে থাকে। বেলা হয়েছে অনেক। আর একটু পরেই নিফু ডাকতে আসবে খাওয়ার জন্য। ওর চাচাতো ভাই। গ্রাম বদলে গেলেও কিন্তু ভালবাসা বদলে যায়নি। আজও একে অপরকে ভালবাসে। বিপদে আপদে ছুটে আসে। এই ভালবাসার শিকড়টাকে ছেঁড়া যাবে না কোনও কালেই। ফুরাদ এখানে আসার পর অনেক সময় কিছু বদল দেখছে। রাজনীতি আজ গোটা গ্রাম জুড়ে। কিছুটা ফাটল ধরেছে ভালবাসায়। তাই বলে মানুষ
এখনও বদলে যায়নি। দেখা হলেই কথা হয়। খোঁজ নেয়। বিড়ি বিনিময় হয়। মাঠে জল খাবার ভাগ করে খায়। পাশাপাশি সব বাস।
ফুরাদ আর বসে থাকে না। সোজা নদীর কাছে চলে যায়। ওর মন আবার উতলা হয়ে ওঠে। কী যেন আজ তাকে খুঁজে পেতেই হবে।
মন মানছে না। ও নদীর পাড়ে এসে দাঁড়ায়। শীতল বাতাস বইছে। ফুরাদ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। নদীর সঙ্গে ও কথা বলে। গন্ধা ওর জীবনটাকে এলোমেলো করে দিয়ে গেছে। ওর সামনাসামনি হতেই হবে ওকে। ফুরাদ মনে শক্তি আনে।
‘তিন’
কেমন আছ ফুরাদদা? এতদিন কোথায় ছিলে? ভাবলাম হয়তো আর দেখা হবে না। দেখা না হলেই ভাল হতো। কেন? না। এমনি।
গন্ধা, সব কি জীবন থেকে হারিয়ে যায়? থাকে অবশিষ্ট কিছু। যা নিয়ে বাঁচা যায়। ঠিকই বলেছ। জীবনের সামনেটা কেউই দেখতে পায় না। তবু এগিয়ে চলে মানুষ। গন্ধা বলে কথাটা। হালদার বাড়ি এখন ফাঁকা। ওর একা জীবন কেমন করে কাটে কে জানে। গন্ধাকে দেখতে এখন অনেক খারাপ হয়ে গেছে। তবে চোখ দুটো এখনও উজ্জ্বল। ওর গায়ের রং
একই আছে। তবে ও শুকিয়ে গেছে। গন্ধা আর আগের মতো নেই। ওর মুখ-চোখ দিয়ে যেন তেল পিছলে পড়ত। আজ ওকে হাত বাড়িয়ে ছুঁতে খুব ইচ্ছে করছে। ফুরাদ আসাতে ওর চোখ দুটো যেন আলতো উজ্জ্বল। ঝিলিক দিচ্ছে কি? গন্ধার জীবন
কীভাবে বদলে গেল! ও নদীর মতো ছিল। আজ যেন একটা মরা বিল। হায়রে জীবন! মানুষের হাতে কিছু নেই। ওপরওয়ালা যেমনটি চাইবে তেমনটিই ঘটবে। হঠাৎ হেমন্তের হিম বাতাস এসে ওদের দু’জনকে
জড়িয়ে ধরে। বেশ হিম হিম ভাব চারপাশে। তুলসীতলাতে কেমন সন্ধে নামছে। আর একটু পরে গন্ধার মুখটা অন্ধকারে ঢেকে যাবে। ফুরাদের মনটা খারাপ হয়ে যায়। ওরও যাবার সময় হল। কালই ফিরে যাবে। এমন
সময় হঠাৎ গন্ধা বলে, ফুরাদদা, তোমার একটা জিনিস আমার কাছে আছে। তোমাকে ওটা দিতে চাই। বলেই উঠে পড়ে। তারপর ও
ফিরে আসে একটু পরে। ফুরাদ ওঠে দাঁড়ায়। দূরে কোথায় শাঁখ বাজছে। পুজোর গন্ধটা আর নেই। হেমন্তের হিমে ঢেকে গেছে। গন্ধা এসে ওর সামনে দাঁড়ায়। ফুরাদদা, এটা আমাকে দিয়েছিলে। এখন হয়তো তোমার
মনে নেই। এটা রাখো তোমার কাছে। দেখছে একটা শুকনো ছাতিম পাতা। যেটাতে অনেক ভালবাসা জড়িয়ে আছে। সময় ধরা আছে
ওতে। ফুরাদ হাত বাড়িয়ে ছোঁয় পাতাটাকে। যেন তার মনের নদীতে একটা নৌকো ভেসে যাচ্ছে একটু একটু করে।

—রাজকুমার শেখ

Dainik Digital

Dainik Digital

Leave a Reply

Your email address will not be published.