দায়িত্ব এড়ানোর কৌশল

 দায়িত্ব এড়ানোর কৌশল
এই খবর শেয়ার করুন (Share this news)

কোভিডের বীভৎসতা কেটে গেছে প্রায় দু’ বছর। কিন্তু কোভিড নিয়ে জনমনে জমে থাকা প্রশ্ন বুদবুদের মতোই ক্রমেই প্রকাশ্যে আসছে। ২০২১ সালে করোনা টিকা নেওয়ার পর দুই তরুণী অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন দুইটি পৃথক ঘটনায়।এর মধ্যে ঋতিকা গঙ্গুর বাড়ি হায়দ্রাবাদ।আর করুণা গোবিন্দনের বাড়ি কোয়াম্বাটুর।এরা ২০১১ সালের জুন মাসে কোভিডের টিকা নেওয়ার পর যথাক্রমে দু-সপ্তাহ এবং ১মাসের মধ্যে মারা যান। দুজনেই থ্রম্বোসিস অ্যাণ্ড থ্রম্বোসাইটোপেনিয়া সিনড্রোমে আক্রান্ত ছিলেন এবং পরবর্তী সময়ে মারা যান।আসলে কোভিড টিকা নেওয়ার পর বিশ্বের বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে এই টিটিএসে আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা প্রকাশ্যে আসে।

ভারতে কোভিড ভ্যাকসিন নেওয়ার পর এই রোগে আক্রান্ত হয়েছেন ২৬ জন।যাদের মধ্যে এই দুই তরুণী সহ মারা গেছেন ১২ জন।ঘটনা হলো, এই দুই মৃতার পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে কোভিড টিকা নেওয়ার পর শরীরে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার কারণেই তাদের মৃত্যু হয়েছে। সুতরাং কেন্দ্রের কাছে ক্ষতিপূরণের দাবি জানিয়েই এই দুই মৃতার পরিবারের পক্ষ থেকে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন জানানো হয়। সম্প্রতি সুপ্রিমকোর্ট এই তবুও গুরুত্বপূর্ণ ও সংবেদনশীল ইস্যুতে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে কোভিড টিকাকরণ এবং টিকাকরণের পর মৃত্যু নিয়ে সরকারের বক্তব্য জানতে চেয়েছিল। তাতেই কেন্দ্রীয় সরকার সুপ্রিমকোর্টকে এক হলফনামা জমা বাংলা দিয়ে জানায়।

এই বছর ১৯ নভেম্বর পর্যন্ত দেশে ২১৯ কোটি ৮৬ লক্ষ কোভিড ভ্যাকসিনের ডোজ মানবদেহে প্রয়োগ করা হয়েছে। এর মধ্যে পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া বা বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে ০.০০৪২ শতাংশ ক্ষেত্রে। অর্থাৎ ৯২,১১৪ টি ডোজের ক্ষেত্রে ভ্যাকসিন দেওয়ার পর কিছু সমস্যা বা প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে। যদিও এর মধ্যে ৮৯,৩৩২ টি ক্ষেত্রেই এগুলি ছিল।অতি সাধারণ প্রতিক্রিয়া। শতাংশ হিসাবে যার পরিমাণ ০.০০৪১ শতাংশ। বাদবাকি যে ২৭৮২ টি ডোজে সমস্যা দেখা গেছে, এই সবগুলোই গুরুতর ন্যূনতম প্রতিক্রিয়া। এদের মধ্যে কেউ কেউ মারাও গেছেন।সুপ্রিমকোর্টে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রক যে হলফনামা জমা দিয়েছে, তাতে যে কথাটা সরকার বলার চেষ্টা করছেন সেটা হলো, করোনার প্রতিষেধক নেওয়ার কারণে কী ধরনের ক্ষতিকর প্রভাব শরীরে পড়েছে, তা নিয়ে বর্তমানে পুঙ্খানুপুঙ্খ গবেষণা চলছে।

তাই টিকাকরণের কারণেই কারও কারও মৃত্যু হয়েছে এমনটা নিশ্চিত করে বলার সময় এখনই আসেনি। অর্থাৎ টিকাকরণে যে মৃত্যুর একমাত্র কারণ বিদেশি সেরকমটা এখন বলা যাবে না। তাই মৃতার পরিবার যদি এই মৃত্যুর পেছনে কোভিড ভ্যাকসিনকেই দায়ী করে থাকে সেক্ষেত্রে তাদের দেওয়ানি আদালতেই ক্ষতিপূরণের মামলা করতে হবে। এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে কাজ কেন্দ্রীয় সরকার টিকাকরণের পরে কারও মৃত্যু হয়ে থাকলে তার দায়ভার নিতে শুধু অস্বীকারই করেনি। পাশাপাশি টিকা সংস্থাগুলোকে যাতে মত্যুর জন্য কোনও ক্ষতিপূরণ দিতে না হয় সেজন্য বহুজাতিক সেই সংস্থার পক্ষেও প্রকারান্তরে পাশে দাঁড়ানোর বার্তা দিল।

কেন না, সুপ্রিমকোর্টে পেশ করা মামলায় মৃতা দুই তরুণীর পরিবারের পক্ষে আইনজীবী যুক্তি দেখিয়েছিলেন, টিকাকরণের ফলে কী ক্ষতিকর প্রভাব দেখা যেতে পারে।তা টিকা নেওয়ার আগে সম্মতিপত্রে লেখা থাকলে এই মৃত্যু এড়ানো যেত। কিন্তু বিস্ময়কর ঘটনা হলো সরকার তার হলফনামায় বলছে যেহেতু কোভিডের টিকা নেওয়া বাধ্যতামূলক ছিলো না,তাই সম্মতিপত্রে ক্ষতিকরন প্রভাবের উল্লেখের প্রয়োজন মনে করেনি সরকার। সরকার হলফনামা জমা দিয়ে যতই দাবি করার চেষ্টা করুন, করোনার টিকাকরণ সরকারী নির্দেশিকা অনুসারে বাধ্যতামূলক ছিলো না, কিন্তু এটাও তো বাস্তব সত্য, দেশে লকডাউন সংক্রান্ত বিধিনিষেধ উঠে যাওয়ার পরে বিমান ও রেল যাত্রার ক্ষেত্রে কোভিড টিকা নেওয়ার প্রমাণপত্র দেখানো বাধ্যতামূলক করেছিল বিমানসংস্থা ও রেল মন্ত্রক।

আবার এটাও তো সত্য যে, সরকারীভাবে যারা কোভিড পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত ছিল যেমন চিকিৎসক, সমস্ত ধরনের স্বাস্থ্যকর্মী, ফ্রন্ট লাইনার ওয়ার্কার, সরকারী দপ্তরের কর্মী, অত্যাবশ্যকীয় সংস্থায় কর্মরত চাকুরে, শিক্ষক, ভোট কর্মী সকলকেই সরকার বাধ্য করেছিল কোভিডের টিকা নিতে। আবার কাগজেপত্রে সরকার যেহেতু টিকাকরণ বাধ্যতামূলক নয় বলে সরকারী নির্দেশিকা জারি করেছিল,এখন সেই সরকারী নির্দেশিকাকে কাজে লাগিয়ে তাদের বাঁকা পথ দিয়ে ক্ষতিপূরণ থেকে নিজেকে এবং টিকা উৎপাদনকারী সংস্থা উভয়কেই রক্ষা করার কৌশল ফেঁদেছে সরকার। কিন্তু সরকারের এই যুক্তি যদি মেনেও নেওয়া হয়, তাহলে এটা তো খুব প্রাসঙ্গিকভাবেই জানতে চায় মানুষ যে, টিকা নেওয়ার পরে যাদের বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় প্রাণহানি হয়েছে, সেই মৃত্যুর দায় কে নেবে ?

Dainik Digital

Dainik Digital

Leave a Reply

Your email address will not be published.