মর্মান্তিক ৮ মৃত্যুর ঘটনার সাক্ষী ‘গাছ’!
৩৪ বছর আগের এক মর্মান্তিক ঘটনার সাক্ষ্য বহনকারী সেই বটবৃক্ষটি আজও জীবিত। বৃক্ষটিকে দেখলে মনে হবে এই বুঝি প্রাণটা চলে যায়। বৃক্ষটির বেশিরভাগ অংশই বর্তমানে পচে গেছে। তারপরও আছে জীবিতই। ঘটনাটি আশির দশকের প্রায় শেষ সময়ে, যখন হাতে হাতে ছিলো না যোগাযোগ মাধ্যম মোবাইল কিংবা টেলিফোন। দমকল বা পুলিশ থানাগুলিতেই ছিলো সীমাবদ্ধ । সালটা হবে ১৯৮৯ এবং চৈত্র মাস। হালাহালি থেকে পরপর তিনটি গাড়িতে করে মোট ৯টি গরুকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে দক্ষিণ জেলার কোথাও । প্রতি সপ্তাহে হালাহালি, কুলাই বাজারে পাইকাররা আসতো গরু কিনতে। সেই সময় গরুর গাড়ি থেকে চাঁদা সংগ্রহের তেমন কোনও চল ছিলো না। আজ যেমনটা হরদম হচ্ছে। তাও খুল্লাম খুল্লা। সেই সময়ে আমবাসার বেশ কজন মস্তান তিনটি গাড়িকে আটক করে চালকদের কাছে দাবি করে ২০ হাজার টাকা চাঁদা দিতে হবে। তিনটি গাড়ির চালকরা অসম্মত হয়। মূল ক্রেতার সাথে বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে বলে চালকরা সেই চাঁদাবাজদের। কিন্তু না, চাঁদাবাজরা মানতে রাজি নয়। গাড়ি থেকে নয়টি গরুকে নামিয়ে ছোট্ট দড়ি দিয়ে উল্লিখিত বটগাছটিতে বেঁধে রাখে। চালকদের গাড়িসুদ্ধ ছেড়ে দেয় মূল মালিকের কাছ থেকে চাঁদার টাকাটা নিয়ে এসে গরুগুলিকে নিয়ে যেতে। সেইমতো গাড়ি নিয়ে চালকরা চলে গেলেও চাঁদার টাকা নিয়ে আসেনি কেউ। দু-তিন দিন চলে যায়। গরুগুলিকে উপোস রেখে দেয় মস্তান বাহিনীর যুবকরা। খাবার তো দূর, সামান্য জলটুকু পর্যন্ত দেওয়া হয়নি অবলা প্রাণীদের। চারদিনের পর গলায় ছোট্ট বাঁধন নিয়েই একে একে আটটি গরু বটগাছটিকে সাক্ষী রেখে মারা যায়। কোনওক্রমে বেঁচে যায় একটি গরু। তৎকালীন মস্তান যুবকরাই সেই গরুগুলির মৃত্যুর জন্য দায়ী। যদিও বর্তমান প্রজন্মের আশা এই ধরনের গর্হিত কাজ সমাজ থেকে চিরতরে বন্ধ হবে। চাঁদা চাই? কথা বলুন, আলোচনা করুন মালিকের সাথে। তাই বলে অবলা প্রাণীদের কষ্ট দেওয়া মোটেও সুখকর হবে বলে মনে হয় না। আজ সেই অর্ধমৃত দাঁড়িয়ে থাকা বটবৃক্ষটি দেখলেও মনে হয় বৃক্ষটিও যেন কাঁদছে অনুশোচনায়।এদিকে কালক্রমে মস্তান বাহিনীর সিংহভাগই নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। বর্তমানে জানা মতো দু’জন এখনও জীবিত রয়েছেন। তারা আজ নিজেরাও সেই দিনের মর্মান্তিক ঘটনাটি মনে করলেও কারোর কাছে ওই দিনের বিষয়টি খুলে বলতে পারছে না। নাম না করার অঙ্গীকারে আবদ্ধ করে এলাকার এক সুহৃদ ব্যক্তি বিষয়টি প্রকাশ করেন প্রতিবেদকের কাছে। আমবাসা থানা সংলগ্ন ইয়ং ব্লাড ক্লাবের বিপরীত দিকে বিশাল কচুরিপানায় বেষ্টিত স্থানে থাকা অর্ধমৃত বটগাছটিকে দেখিয়ে ৩৪ বছর আগের ঘটনাপ্রবাহ তুলে ধরেন সেই ভদ্রলোক। তিনি বলেন, গাছটিকে দেখলেই আমার চোখে ভেসে উঠে সেই অসহনীয় দিনটির কথা। সেই সময়ের কুখ্যাত যুবকরা একটা সময় কঠিন ব্যাধিতে মৃত্যু হলেও এখনও বেঁচে আছে না বাঁচার মতোই দু’জন। গাছটিকে দেখলে মনে হয়, গাছটি নিজে সেই দোষের ভাগীদার হয়েই জীবিত রয়েছে। হয়তো বৃক্ষটিও কিছু বলতে চায় কিন্তু পারছে না। তাই সেই সুহৃদ ভদ্রলোকের মাধ্যমে বেঁচে থাকা অর্ধমৃত বটগাছটিও সেই মর্মান্তিক দিনের ঘটনাপ্রবাহ প্রতিবেদকের মাধ্যমে তুলে ধরছে জনসমাগমে। হয়তো ঘটনাপ্রবাহ প্রকাশের মাধ্যমে বটগাছটিও বর্তমান প্রজন্মের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী। এমনিতেই হিন্দু সমাজে গৃহপালিত কোনও প্রাণী গলায় বাঁধন নিয়ে মৃত্যু হলে মালিককে প্রায়শ্চিত্ত করতে হয়। সেই দিনের মানুষগুলি তো প্রায়শ্চিত্ত মোটেও করেনি। তাই হয়তো সেই নামহীন ভদ্রলোকের মাধ্যমে প্রাণ কেঁদে ওঠা মর্মান্তিক বিষয়টি বটগাছটিও প্রতিবেদকের মাধ্যমে প্রকাশ করে প্রায়শ্চিত্ত করতে চাইছে। বর্তমানে বেশ কিছু যুবক অজান্তেই এই কাজটি করে চলেছে। গরুর গাড়ি আটক করে চাঁদা তোলা তাদের অভ্যাসে পরিণত হয়ে দাঁড়িয়েছে।