ত্রিপুরায় ভোটের সেকাল একাল!

 ত্রিপুরায় ভোটের সেকাল একাল!
এই খবর শেয়ার করুন (Share this news)

“ত্রিপুরায় মানুষের রায় এখন বাক্সবন্দি। আগামী ২ মার্চ খোলা হবে ইভিএম। তখনই জানা যাবে গণদেবতাদের রায় । এখন শুধু অধীর অপেক্ষা আর উত্তেজনার আগুন পোহানো । গত মাসাধিক কাল ত্রিপুরা অনেক কিছু প্রত্যক্ষ করেছে। নির্বাচনি প্রচার আর ভিআইপিদের আগমনে রাজ্য ছিল সরগরম। অবশ্য সেদিনও সেই পঞ্চাশ-ষাট দশকেও ভোট ছিল, ছিল ভোটের প্রচারও। তবে সবটাই অন্যরকম। তখন মাইকের ব্যবহারই তেমন চালু হয়নি। আর আজকের যুগের অন্তর্জালের কথা তো কল্পনাতেই নেই। মিছিল, সভা, স্কোয়ার্ডিং ইত্যাদি অবশ্য ছিল। তবে সেসব আজকের তুলনায় খুবই সীমিত মাত্রায়। স্মৃতি থেকে বলছি সাড়ে পাঁচ দশক আগেকার ভোট প্রচারের কথা। সেই সঙ্গে পর্যায়ক্রমে আসছে তাতে আড়ম্বরের কিছু কথাও।

১৯৪৯ সালের ১৫ অক্টোবর ত্রিপুরার ভারতভুক্তি ঘটে। সুদীর্ঘকাল ব্যাপী মাণিক্য রাজবংশের শাসনের পর ত্রিপুরায় গণতান্ত্রিক অধ্যায়ের সূচনা হয়। ১৯৫২ সালের জানুয়ারী মাসে সারা দেশের সঙ্গে ত্রিপুরাতেও সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সেবার ত্রিপুরার দুটি লোকসভার আসন এবং রাজ্যসভার একটি আসনের জন্য ৩০ সদস্য বিশিষ্ট এক ইলেক্টোরাল কলেজ গঠনে নির্বাচন হয়েছিল। লোকসভার দুটি আসনে বিজয়ী হন কমিউনিস্ট পার্টির প্রার্থীরা। ইলেক্টোরাল কলেজেও তাদেরই সাফল্য ঘটে। ১৯৫৭ সালের মার্চ মাসে অনুষ্ঠিত দেশের দ্বিতীয় সাধারণ নির্বাচনের সঙ্গে ত্রিপুরার ৩০ আসন বিশিষ্ট আঞ্চলিক পরিষদের নির্বাচনও অনুষ্ঠিত হয়।

কংগ্রেস ও কমিউনিস্ট পার্টি লোকসভার একটি করে আসন পায়। আঞ্চলিক পরিষদে উভয় দলই পায় ১৫টি করে আসন। কিন্তু কেন্দ্ৰীয় সরকার মনোনীত অতিরিক্ত দুজন সদস্যের সমর্থন লাভ করায় কংগ্রেস পরিষদের ক্ষমতা লাভে সমর্থ হয়। ১৯৬২ সালের সাধারণ নির্বাচনে লোকসভার দুটি আসনেই কমিউনিস্টরা বিজয়ী হলেও আঞ্চলিক পরিষদে কংগ্রেস পায় ১৭টি আসন। ১৯৬৩ সালের ১ জুলাই কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল আইন অনুযায়ী ত্রিপুরা আঞ্চলিক পরিষদ ত্রিপুরার প্রথম বিধানসভায় রূপান্তরিত হয়। সেদিন শচীন্দ্রলাল সিংহের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের কংগ্রেস মন্ত্রিসভা শপথ গ্রহণ করে।

IMG20221214115753

এখানে উল্লেখ করা যায় যে, ত্রিপুরা বিধানসভা ও মন্ত্রিসভা পেলেও তার জন্য তখন কোনও নির্বাচন হয়নি। ১৯৬২ সালের নির্বাচনে গঠিত আঞ্চলিক পরিষদই সে সময় বিধানসভায় পরিণত হয়।
এবার আসা যাক ১৯৬৭ সালের নির্বাচনের কথায়। তখন নির্বাচন আর নির্বাচনি প্রচার নিয়ে ছিল এক কিশোরের চোখে অপার বিস্ময় । আবছা আবছা মনে পড়ে সেদিনের কথা । কৈলাসহরে প্রায়দিন বিকালে বাড়ির পাশ দিয়ে স্কোয়ার্ডিং যেতে দেখতাম। হাতে হাতে চোঙা। …… ভোট দিন …. ভোট দিন’ স্লোগান দিয়ে চলছে চোঙা ফুকিয়ে। না, পতাকা ফেস্টুন দেখেছি বলে মনে পড়ছে না। হয়তো বা ছিল কিন্তু দাগ কাটেনি মনে।

poll-election-symbol-wikipedia

সেদিনের প্রচার পর্বে দলীয় প্রার্থীকে ভোট দেওয়ার আবেদন জানিয়ে স্কোয়ার্ডিংয়ের কথাই মনে গেঁথে আছে। ১৯৬৭ সালের ২১ ফেব্রুয়ারী অনুষ্ঠিত ৩০ সদস্য বিশিষ্ট রাজ্য বিধানসভার নির্বাচনে মোট ভোটার ছিলেন ৬০৫৯৩৪জন। সেবার ভোট পড়েছিল ৭৪.৩২ শতাংশ। সেই ভোটে ২৭টি আসনে জয়ী হয়েছিল কংগ্রেস এবং বাকি ৩টির মধ্যে ২টি সিপিএম ও ১টি সিপিআই । লোকসভার দুটি আসনেই জয়ী হয়েছিল। কংগ্রেস। পরবর্তী সময়ে রাজ্যে ভোটারের সংখ্যা যেমন বাড়তে থাকে তেমনি বেড়ে চলে নির্বাচনি প্রচারের জৌলুসও। ১৯৭২ সালের ২১ জানুয়ারী ত্রিপুরা পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদা লাভ করে। বিধানসভার সদস্য সংখ্যা হয় ৬০।

সে বছর ১১ মার্চ অনুষ্ঠিত রাজ্য বিধানসভার নির্বাচনে কংগ্রেস পায় ৪১টি আসন, সিপিএম ১৮ এবং সিপিআই ১টি আসন লাভ করে। সেবার রাজ্যে ভোটার ছিলেন ৭৬৬,০৯৩জন। ভোট পড়েছিল ৬৭.৩৬ শতাংশ যা গত সাধারণ নির্বাচনের তুলনায় কিছুটা কম। পূর্ণ রাজ্যের প্রথম বিধানসভা নির্বাচনে প্রচারে আড়ম্বর অনেকটাই বেড়ে গিয়েছিল। মিছিল, মিটিং, স্কোয়াডিং আর পোস্টার-ফেস্টুনে সর্বত্র ছিল। ভোটের উত্তাপ। ছিল সকাল-সন্ধ্যায় মাইকের গর্জন। বাড়ি বাড়ি প্রচার আর রাজনৈতিক দলের পক্ষে ভোটার ফ্লিপ বিলি তো ছিলই। তখন রাজনৈতিক সহনশীলতার এক আশ্চর্য বাতাবরণ ছিল। সে বছর নির্বাচনি সভায় ভাষণ দিতে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এসেছেন কৈলাসহর।

সভা হয়েছিল বিমানবন্দর সংলগ্ন মাঠে। সেদিন প্রধানমন্ত্রীর সভাতেই কিছু অত্যুৎসাহী তরুণের মুখে হঠাৎই ‘ইনক্লাব জিন্দাবাদ’ স্লোগান উঠেছিল। কিন্তু তাতে তেমন কোনও প্রতিক্রিয়া হয়নি। আজকের দিনে এটা ভাবা যায়? এমনটাই ছিল সহনশীলতার বাতাবরণ। প্রচারে, ভোটের দিনে, এমনকি ফলাফল প্রকাশের পরও প্রতিদ্বন্দ্বী দুই দলের কর্মীরা একসঙ্গে চায়ের দোকানে আড্ডা দিয়েছে।
পরবর্তী সময়ে পরিস্থিতি অবশ্য পাল্টে যেতে থাকে। ধীরে ধীরে রাজনৈতিক হিংসা ঘটতে থাকে। বিনষ্ট হতে থাকে সহনশীলতার বাতাবরণ। ১৯৭৭ সালের ৩১ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত বিধানসভার নির্বাচনে ভোটের হার অনেক বেড়ে গিয়েছিল। সেবার ভোটের হার ছিল ৭৯.৫১ শতাংশ। বেড়ে গিয়েছিল ভোটারের সংখ্যাও । ভোটার ছিল। ৯৬১,৯৯৮জন।

সেবার নির্বাচনি প্রচারের জৌলুস আরও অনেক বেড়ে গিয়েছিল। পোস্টার-ফেস্টুন, মিছিল-স্কোয়াডিং ইত্যাদির পাশাপাশি রাস্তায় রাস্তায় নির্মিত হয়েছিল বড় বড় তোরণ। হয়েছিল আলোকসজ্জা। সেই নির্বাচনে বামফ্রন্ট ৫৬টি আসন এবং ত্রিপুরা উপজাতি যুব সমিতি ৪টি আসন লাভ করেছিল। ১৯৮৩ সালের জানুয়ারীতে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে সব দলেরই প্রচার আরও তেজি হয়েছিল। বড় বড় সভা, মিছিল, পোস্টার-ফেস্টুন, তোরণ ইত্যাদিতে জমজমাট ছিল নির্বাচনি প্রচার। প্রচারে ছড়া বাঁধা, গান লেখা ইত্যাদির সুচনা হয় তখন। ১৯৮৩ সালে আগরতলার বনমালীপুর কেন্দ্রে ইভিএম-এ ভোটদান হয়। সেবার রাজ্যে ক্ষমতাসীন হয়েছিল বামফ্রন্ট।

১৯৮৮ সালের নির্বাচনে প্রচারের মাত্রা, জৌলুস আরও বেড়ে যায়। সেইসঙ্গে অনুপ্রবেশ ঘটতে থাকে হিংসার। সেবার প্রচারে প্রথম দেখা যায় উঁচু উঁচু বাঁশের মাথায় বড় আকারের দলীয় পতাকা। দেখা যায় বিরাট বিরাট ফেস্টুন। তবে এর পাশাপাশি বিভিন্ন দলের প্রতীক সম্বলিত ছোট ছোট স্টিকারও দৃশ্য প্রচারে প্রভাব বিস্তার করে। খবরের কাগজের পৃষ্ঠায় রাজনৈতিক দলের বিজ্ঞাপন শুরু হয় দলের প্রতীক চিহ্নে ভোটদানের আবেদন জানিয়ে। সেবার কংগ্রেস ও উপজাতি যুব সমিতি জোট ভোটে জয়লাভ করে। ১৯৯৩ সালের বিধানসভা নির্বাচনে হিংসাত্মক ঘটনার মাত্রা আরও বেড়ে যায়। পরবর্তীকালে নির্বাচনি প্রচারে যুক্ত হতে থাকে নিত্য নতুন উপকরণ।

সেবার বামফ্রন্টের প্রত্যাবর্তন ঘটে। তারপর থেকে একনাগাড়ে ২৫ বছর ক্ষমতায় থাকে বামফ্রন্ট। প্রতিটি বিধানসভা নির্বাচনে জোরদার প্রচার করে প্রতিদ্বন্দ্বী সব দল। তবে বামফ্রন্টের প্রচার ছিল তুলনায় তেজি। বড় বড় সভা সমাবেশের পাশাপাশি পাড়ায় পাড়ায় ছোট মাপের সভা, বাড়িতে বাড়িতে উঠান সভা ইত্যাদি হতে থাকে। মিছিলের পাশাপাশি ‘রোড শো’ নামে এক নতুন ধারার সংযোজন ঘটে নির্বাচনি প্রচারে। সঙ্গে পোস্টার-ফেস্টুনের সাবেকি প্রচার তো ছিলই। অবশ্য বড় বড় ফ্লেক্স ব্যানারেরও সংযোজন ঘটেছে ইতিমধ্যে। সেইসঙ্গে বিভিন্ন দলের প্রচারমূলক গানের ক্যাসেট বেরুতে থাকে। ভোট গ্রহণেও চালু হয়ে যায় ইভিএম।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় পর্যাপ্ত নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েন সহ নির্বাচন কমিশনের নজরদারিও বাড়তে থাকে। রাজনৈতিক দলের নির্বাচনি প্রচারের পাশাপাশি ভোটারদের সচেতন করার লক্ষ্যে নির্বাচন কমিশনের নানা প্রচারও চলতে থাকে। ২০১৮ সালের বিধানসভা নির্বাচন থেকেই তথ্য প্রযুক্তির প্রবল প্রভাব পরিলক্ষিত হতে থাকে নির্বাচনি প্রচারে। হাতে হাতে এনড্রয়েড মোবাইল, ঘরে ঘরে দ্রুত পৌঁছে যাচ্ছে রাজনৈতিক দলের প্রচার। ফেসবুক, ইউটিউব সহ সামাজিক মাধ্যমে নানা রাজনৈতিক বার্তা। কিন্তু সাবেকি প্রচার পরিত্যক্ত হয়নি। পাশাপাশি চলছে তাও। মিছিল, মিটিং, রোড শো, দুয়ারে দুয়ারে প্রার্থীর উপস্থিতি —সবই চলছে।

রাস্তার দৃপাশে পতপত করে উড়ছে প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলোর পতাকা। তবে নির্বাচন কমিশনের নির্দেশে পতাকা লাগানোর উচ্চতা ইতিমধ্যে অনেক কমে গেছে। সেই নির্বাচনে বিজেপি- আইপিএফটি জোট জয়ী হয়েছিল। বিজেপি ৪৩.৪৯ শতাংশ ভোট পেয়ে ৩৬টি আসনে জয়ী হয়েছিল। সিপিএম তথা বামফ্রন্ট ৪২.22 শতাংশ ভোট পেয়ে ১৬টি আসনে জয়ী হয়েছিল। আইপিএফটি ৭.৫ শতাংশ ভোট পেয়ে দখল করেছিল ৮টি আসন।
নির্বাচনি প্রচারের ব্যাপারেও নির্বাচন কমিশন থেকে নানা বিধি আরোপিত হয়েছে পর্যায়ক্রমে। প্রচারে ব্যয়ের সর্বোচ্চ মাত্রাও বেঁধে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তা কতটা সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হয় সে প্রশ্ন থেকেই যায়।

চলতি বছর অর্থাৎ ২০২৩ সালের নির্বাচনে ভোটারের সংখ্যা বেড়ে হয় ২৮ লক্ষ ১৪ হাজার ৫৮৪। এবার ইভিএমে ভোট পড়েছে ৮৭.৭৬ শতাংশ। তার সঙ্গে পোস্টাল ব্যালট, সার্ভিস ভোট ইত্যাদি মিলিয়ে মোট প্রদত্ত ভোট হবে ৯০ শতাংশের কাছাকাছি। এবার নির্বাচন কমিশনের নজরদারি আরও কঠোর। ভোটারদের সচেতন করা সহ হিংসা শূন্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের উদ্যোগ। বুথে বুথে ওয়েব ক্যামেরা। সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রতিটি বুথে রিটার্নিং অফিসারের প্রতি মুহূর্তের নজরদারি। শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের লক্ষ্যে রাজ্যে ৪০০ কোম্পানি আধা সামরিক বাহিনী। এদিকে ভোটের প্রচারেও এবার আরও জৌলুস। মিছিল মিটিং-এ চোখ ধাঁধানো উপকরণ, সাজসজ্জা আর প্রাচুর্যের ছাপ।

মাটিতে শতরঞ্জির উপর বসে নেতাদের বক্তৃতা শোনার দিন গত হয়েছে অনেক আগেই । শ্রোতাদের জন্য এখন হাজার হাজার চেয়ারের বন্দোবস্ত হয়। গোটা শহর-জনপদ জুড়ে মাইকের হর্ন। সব মিলিয়ে এলাহি আয়োজন। মিছিল-সমাবেশ তো আছেই, বৃহৎ সংযোজন ‘রোড শো’। এতে শামিল হচ্ছেন কেন্দ্রীয় মন্ত্ৰী সহ অন্য রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরাও। এতে দলীয় পতাকার পাশাপাশি উড়ছে পতাকার রঙের বিপুল সংখ্যক বেলুনও। আছে খবরের কাগজে পৃষ্ঠা জুড়ে বিভিন্ন দলের পক্ষে বিজ্ঞাপন। তবে সব কিছুকে যেন ছাপিয়ে যাচ্ছে সামাজিক মাধ্যম। কোনও ঘটনা ঘটলে মুহূর্তেই তা ছড়িয়ে পড়ছে দেশ দেশান্তরে। নির্বাচনি প্রচারেও প্রভাব বাড়ছে সামাজিক মাধ্যমের। কিন্তু আধুনিক প্রচার উপকরণ সত্ত্বেও পোস্টার- ফেস্টুন, সমাবেশ, মাইকের গর্জন, আছে সাবেকি সবই। সব মিলিয়ে এটা বলা যায় যে, গণতন্ত্রের শ্রেষ্ঠউৎসবের প্রচারেও পরম্পরাকে সঙ্গে নিয়েই যেন চলতে চাই আমরা।

Dainik Digital

Dainik Digital

Leave a Reply

Your email address will not be published.