রাজ্যপালকে ঘটনা জানিয়ে ফিরে গেল সাংসদ দল!
সন্ত্রাসের শিকার সাংসদ দল সফর সংক্ষিপ্ত করে ফিরে গেছে মঙ্গলবার। যাবার আগে রাজ্যপালের সঙ্গে দেখা করে নির্বাচনোত্তর সন্ত্রাস বন্ধে প্রশাসনকে জাগাতে অনুরোধ করে গেছেন। সাংবাদিক সম্মেলনে সাত সাংসদ ও বাম কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ পুলিশ ও প্রশাসনের প্রতি একরাশ অসন্তোষ ব্যক্ত করেছেন। তাদের আশঙ্কা দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর জ্ঞাতসারেই এসব ঘটছে। নতুবা তার তরফ থেকে একটা খোঁজখবর নিশ্চয়ই তাদের কাছে আসতো। এদিনই রাজ্যসভার সাংসদ ডা. ভি সিভাদাসন উপরাষ্ট্রপতি জগদীপ ধনখরকে চিঠি লিখে নেহালচন্দ্র নগরে রাজ্যসভার সাংসদ এলামারান করিমের নেতৃত্বে সাংসদ- বিষয়ক দলের উপর হামলার ঘটনা জানিয়েছেন এবং দোষীদের যাতে শাস্তি হয় সেজন্য উপরাষ্ট্রপতির হস্তক্ষেপ চেয়েছেন।
সকালে রাজ্যপালের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন সাত সাংসদ ই করিম, পিআর নটরাজন, শ্রীমতী রঞ্জিতা রঞ্জন, বিকাশ রঞ্জন ভট্টাচার্য, আব্দুল খালেক, বিনয় বিশ্বাস ও এএ রহিম। রাজ্য নেতাদের মধ্যে ছিলেন জিতেন্দ্র চৌধুরী, বীরজিৎ সিনহা, ডা. অজয় কুমার, আশিস সাহা, জারিতা লাইতফ্লাং প্রমুখ। রাজ্যপালকে লেখা চিঠিতে বলা হয়েছে বিজেপির লোকজনদের একতরফা হামলায় বিরোধী দলের নেতা, কর্মী, সমর্থক, সহানুভূতিশীল মানুষের জীবন, সম্পদ বিপন্ন। চিঠিতে এই ধরনের হামলার ১১৯৯ টি ঘটনার তালিকা জুরে দেওয়া হয় রাজ্যপালকে। বলা হয়েছে সন্ত্রাসের ভয়াবহতায় এই অব্দি তিনজন অসুস্থ হয়ে গেছেন, মারা গেছেন একজন। দুটি জায়গায় গবাদি পশু পুড়িয়ে মারা হয়েছে। শস্য, বাগিচা পোড়ানো হচ্ছে। বিরোধী দলের লোকদের কাছ থেকে চাঁদা নেওয়া হচ্ছে জোরজুলুম করে বিজয় উৎসবের জন্য। মানুষ ঘরে থাকতে সাহস পাচ্ছেন না, জঙ্গলে রাত কাটাচ্ছেন।
দুপুরে সাংবাদিক সম্মেলনে সাংসদ ও বিধায়করা জানান, ত্রিপুরায় মানুষের ওপর যে অত্যাচার ও আক্রমণ নামিয়ে আনা হয়েছে তা কোনো সভ্য দেশে ভাবা যায় না। আক্রান্তদের কাছে ছুটে যাওয়া সংসদ সদস্যদের যেভাবে আক্রমণ করা হয়েছে তা সরাসরি সংসদের ওপর, গণতন্ত্রের পীঠস্থানের ওপর ও সংবিধানের ওপর আক্রমণ বলে তিনি মন্তব্য করেন। শনিবার রাজ্য অতিথিশালায় সাংবাদিক সম্মেলনে এই অভিযোগ করেন সাংসদ এ এ রহিম।
তিনি বলেন, রাজ্যের পুলিশ প্রধান বলছেন আমাদের অনুমতি নিয়ে যাওয়া উচিত ছিল। তার প্রশ্ন, আমরা আমাদের দেশের মানুষের কাছে যাব, তার জন্য অনুমতি কেন লাগবে? যদি তাই হবে তাহলে এসকর্ট কেন দিলেন? সাংসদ রহিম বলেন, আমরা এখানে আসার আগে ত্রিপুরার মুখ্যসচিবকে জানিয়েওছিলাম। আমাদের রাজ্যে আসার পর তিনি একবার খবরও নেননি। যা অশোভন শুধু নয়, সাংসদের সরাসরি অপমান করা। লোকসভার অধ্যক্ষের নজরে আনা হবে এগুলি। রহিম বলেন, যেখানে সাংসদের কোন নিরাপত্তা নেই সেখানে সাধারণ মানুষের অবস্থা সহজেই অনুমেয়। এই ঘটনা গণমাধ্যমের মাধ্যমে সারা দেশের মানুষের কাছে পৌঁছানোর জন্য আহ্বান জানান তিনি। সাংসদ রঞ্জিতা রঞ্জন বলেন, হাজার মানুষ আক্রান্ত হয়েছে। বাড়িঘর ছেড়ে বহু মানুষ পালিয়ে গেছে। এই রাজ্যের অবস্থা জঙ্গলের শাসনকেও হার মানায়। এখানে আইনের শাসন নেই, সংবিধান পুরোপুরি অচল হয়ে পড়েছে এখানে। সাংসদ বিনয় বিশ্বম বলেন, বিষয়টি দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানেন না, তা বিশ্বাস করি না। গতকাল বিজেপি গুণ্ডারা সাংসদদের চারটে গাড়ি গুঁড়িয়ে দিয়েছে পুলিশের সামনে।,,,, প্রশাসনের কোন ভূমিকা নেই। তিনি জানান, সংসদে বিষয়টি তুলবে বিরোধী সাংসদরা। সমস্ত বিশ্বের নজরে আনা হবে ঘটনা। রাজ্যে সন্ত্রাসের কোনো প্রতিকার নেই বলে তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করেন। সাংসদ বিকাশ রঞ্জন ভট্টাচার্য বলেন, মোহনপুরে আমাদের গাড়ি আক্রমণ করার চেষ্টা হয়েছে পুলিশের সামনে। অতিরিক্ত পুলিশ সুপারকে ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য বলার পর তিনি আশ্বাস দিয়েছেন, কিন্তু প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন বলে জানি না । তিনি বলেন, এখানে গো-ভক্তরা গোমাতাকে পুড়িয়ে মারছে। প্রধানমন্ত্রী ভারতকে গণতন্ত্রের মা বলে চিৎকার করেন কিন্তু ত্রিপুরায় গণতন্ত্র ধ্বংসাত্মক রূপ নিয়েছে। আমরা রাজ্যপালের সঙ্গে দেখা করে বলেছি, সংবিধান কার্যকর করতে হবে। রাজ্যপাল রাজ্যের সাংবিধানিক প্রধান। তিনি কী বুঝলেন বা কী করবেন জানি না। তবে এই সন্ত্রাসের ফলে সর্বস্তরের আক্রান্ত ও ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণের দাবি করেন। সর্বদলীয় কমিটি গঠন করে শান্তির গ্যারান্টির দাবি করেন বিকাশ রঞ্জন ভট্টাচার্য। এক প্রশ্নের উত্তরে সাংসদরা জানিয়েছেন, বিষয়গুলো সংসদে তোলা হবে, সরকারের কাছে জবাব চাওয়া হবে। কংগ্রেসের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক ড. অজয় কুমার এক প্রশ্নের উত্তরে বলেন, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ইঙ্গিতে সব হচ্ছে বলে মনে হয়। কারণ যে বীভৎস আক্রমণ নামিয়ে এনেছে বিজেপির গুণ্ডারা এবং যেভাবে সাংসদরা আক্রান্ত হয়েছেন তাতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর একটা মন্তব্য অন্তত পেতাম। উনি ও প্রধানমন্ত্রী চুপ কেন? তিনি প্রশ্ন তোলেন। সিপিএম রাজ্য সম্পাদক জিতেন্দ্র চৌধুরী বলেন, মুখ্যসচিবের কাছে যাবার পর তিনি বলেছিলেন ২৫২জন গ্রেফতার হয়েছে। আজ রাজ্যপালের কাছে সেই সংখ্যা বেড়ে হয়ে গেল আটশোর ওপর। তিনি বলেন, একজনকেও গ্রেপ্তার করা হয়নি। হলে আদালতে হাজির করা হতো, হয়নি। তিনিও সর্বদলীয় বৈঠকের দাবি জানান। এই দুঃসময়ে সাংসদরা যেভাবে পাশে দাঁড়িয়েছেন তার জন্য জিতেন্দ্র চৌধুরী কৃতজ্ঞতা জানান। কংগ্রেসের রাজ্য সভাপতি বীরজিৎ সিন্হা আশঙ্কা করছেন, এই অবস্থা চললে রাজ্যে মানুষ আত্মরক্ষার্থে প্রতিরোধে নামবেই, তখন গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরি হলে দায়ী থাকবে সরকার। কৈলাসহর থেকে সংবাদ প্রতিনিধি জানাচ্ছেন, নেহালচন্দ্রনগরে কংগ্রেস ও সিপিএমের সাংসদ দলের উপর আক্রমণের প্রতিবাদে শনিবার বিকালে কংগ্রেস ও সিপিএমের দলের পক্ষ থেকে শহরে এক বিক্ষোভ মিছিল ও থানা ঘেরাও হয়। কিছুক্ষণ থানা ঘেরাও করার পর কংগ্রেস ও সিপিএমের পক্ষ থেকে এক প্রতিনিধি দল কৈলাসহর থানার ওসির সঙ্গে মিলিত হন। প্রতিনিধি দলে ছিলেন সিপিএম জেলা সম্পাদক কৃষ্ণেন্দু চৌধুরী ও জেলা কংগ্রেস সভাপতি বদরুজ্জামান সহ অন্যান্যরা। প্রতিনিধি দল থানার ওসির মাধ্যমে রাজ্য পুলিশের মহানির্দেশকের কাছে লিখিত ডেপুটেশন প্রদান করেন। ডেপুটেশনে বীরজিৎ সিন্হা ও জিতেন চৌধুরীর জন্য জেড ক্যাটাগরির নিরাপত্তা দেওয়ার দাবি করা হয়। ডেপুটেশন শেষে সিপিএম ও কংগ্রেস কর্মীদের ফিরে আসার পথে মাছ বাজার সংলগ্ন এলাকায় একটি বাজি ফাটালে কিছুটা উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। পরে অবশ্য পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যায়।