কনক্লেভ এবং আমরা
আগরতলায় ত্রিদেশীয় কনক্লেভ এই রাজ্যের মানুষের জন্য এক আশার সুপবন। ভারত, জাপান এবং বাংলাদেশ – এই তিন দেশের কনক্লেভের স্থান যখন আগরতলার কোনও হোটেলের কক্ষ তখন আশা করাই যায় ত্রিপুরা হইতে পারে এই কক্ষে আলোচনার অন্যতম বিষয়। ভারত সরকার উত্তর পূর্বাঞ্চলের জন্য প্রথমে লুক ইস্ট এবং পরে একই উদ্দেশ্য সামনে রাখিয়া অ্যাক্ট ইস্ট নীতি সম্মুখে রাখিয়াছে। এর আগে উত্তর পূর্ব লইয়া নয়াদিল্লীর কোনও নির্দিষ্ট নীতিই ছিল না।
এনইসি বা নর্থ ইস্ট কাউন্সিল গঠনের আগে অবধি সাত রাজ্য লইয়া কোনও যৌথ ভাবনার প্রশাসনিক পরিসরও চোখে পড়ে নাই। তবে এনইসি হইতেই যে ডোনার নামে মন্ত্রকের ধারণা আসিয়াছে তাহা বোঝা যায়।এই সকল প্রস্তুতি চূড়ান্ত হইয়াছে দশক অতিক্রম করিতেছে। কিন্তু এই অঞ্চলের কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন হইতেছে না। যাহা হইতেছে তাহার অধিকাংশ আসামকে ঘিরিয়াই হইতেছে। ক্ষুদ্র অংশ অন্য সকল রাজ্যগুলিতে হইতেছে। ইহার একটি বড় কারণ হইল ভৌগোলিক প্রতিবন্ধকতা। দেশের মূল ভূখণ্ডের সহিত সহজ যোগাযোগে আছে আসাম। ভৌগোলিকভাবেও মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যুক্ত এবং মূল ভূখণ্ড হইতে তাকাইলে আসামকে বলা হইয়া থাকে উত্তর পূর্বের সিংহদুয়ার। সেই সিংহদুয়ার দিয়া ত্রিপুরায় আসিতে চাহিলে ত্রিপুরা হইবে সব চাইতে দূরবর্তী রাজ্য এবং ভৌগোলিকভাবে পশ্চাৎপদতায় সর্বাগ্নে। কিন্তু নয়াদিল্লী যখন অ্যাক্ট ইস্টের কথা বলিবে তখন ইস্ট বলিলে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার সহিত উত্তর পূর্ব ভারতের যোগাযোগকেই বুঝিতে হয়। বুঝিতে হয় এই অঞ্চলের ভৌগোলিক যে রুদ্ধতা তাহা কাটাইয়া দিয়া এই অঞ্চলকে বিশ্ব মাঝারে উপস্থিত করাইয়া দেওয়া।ইহা ছাড়া উত্তর পূর্বাঞ্চলের রুদ্ধতা,পশ্চাৎপদতা ঘুচাইবার আর কোনও পথ নাই। এই ভাবনায় নয়াদিল্লী গত এক – দেড় দশক ধরিয়া কাজ করিয়া চলিয়াছে। এই ধারার কাজকর্মের ধারাবাহিকতার ফলে ত্রিপুরা আজ দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার সিংহদুয়ার হিসাবে পরিচিতি পাইতে চলিয়াছে। মেলিয়া যাইতেছে পথ, মিলাইয়া যাইতেছে রুদ্ধতা। আজন্মের পশ্চাৎপদতার জায়গায় আসিয়াছে মৈত্রী সেতু, আসিতেছে আগরতলা – আখাউড়া রেল সংযোগ। মৈত্রী সেতু পথে সমুদ্রবন্দরের সুযোগ মিলিবে। বাংলাদেশের সহিত স্থলবন্দরে যোগাযোগ আগেই ঘটিয়াছে।
কিন্তু বাস্তবসম্মত নীতি নিয়মের অভাবে ব্যবসা বাণিজ্য কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় পৌঁছিতেছে না। এইবার দরকার দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার সহিত বিমান যোগাযোগ। ত্রিপুরায় তথা উত্তর পূর্বাঞ্চলে উৎপাদিত, সহজলভ্য পণ্যের বাণিজ্যের জন্য সবধরনের যোগাযোগ দরকার। সেই ধারাবাহিকতায়ই আগরতলা বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে উন্নীত করিবার কাজ চলিয়া আসিয়াছে।খুব সহসাই এই সুযোগগুলি সম্পূর্ণভাবে আমাদের সামনে আসিয়া যাইতেছে। এইবার দরকার হইবে সেইসব সুযোগের সঠিক, সুচিন্তিত সদ্ব্যবহার । তবেই রাজ্যটার দিল্লীনির্ভরতা কাটিবে। অর্থনৈতিক রুদ্ধতা কাটিবে। আমরা সকলেই জানি বেকার সমস্যার সমাধান এই রাজ্যে সবচাইতে বড় সমস্যা। আগের বিজেপি সরকারের পক্ষে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈয়ার করা সম্ভব হয় নাই।
এই সরকারকে তাই প্রথম হইতেই এই বিষয়ে ভাবিতে হইতেছে। বিনিয়োগ, পুঁজি নিবেশ ভীষণ জরুরি এই সময়ে। শিল্প গড়ার ক্ষেত্রে দরকার হইবে স্থল, জল পথের যোগাযোগ। আজ আসামের কোনও প্রান্তে কারখানা বসিলে ইহাদের পণ্য চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছানো যত সময়সাপেক্ষ তাহার চাইতে অনেক কম সময়ের মধ্যে কম খরচে ত্রিপুরার কারখানার পণ্য পৌঁছাইয়া যাইবে। ত্রিপুরার পর্যটন, ত্রিপুরার উচ্চশিক্ষা, হাসপাতাল সবখানেই বাংলাদেশের মানুষ আসিয়া সুযোগ লইতে পারিবে, যদি যোগাযোগ ব্যবস্থা রুদ্ধ না হইয়া যায় ৷আজন্মের ভৌগোলিক পশ্চাৎপদতা আজ এই অঞ্চলকে আগাইয়া রাখিতেছে সর্বক্ষেত্রে। এই সময়ে আগরতলায় ত্রিদেশীয় কনক্লেভে এই বিষয়গুলি লইয়াই নিশ্চয়ই কথা বলিবেন ভারতীয় প্রতিনিধিরা। শিল্পের জন্য যোগাযোগ ব্যবস্থা আর বাজারের নৈকট্য ছাড়া এর পরেই প্রয়োজন হইয়া থাকে বিদ্যুতের। ত্রিপুরায় তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলিতে এই সময়ে উদ্বৃত্ত উৎপাদন রহিয়াছে। আর লাগিতেছে জমি এবং জনশক্তি। এর কোনওটারই অভাব নাই আমাদের সামনে। তাই কথা হোক ত্রিপুরায় শিল্প প্রতিষ্ঠা আর বিনিয়োগের বিষয়ে। ইহা করা গেলে কর্মসংস্থানের সুযোগ আসিবে নিজে নিজেই। আর শিল্পের জন্য, বিনিয়োগের জন্য আমাদের চাই মানসিকতার উন্নয়ন। আমাদের থাকিতে হইবে অতিথিবৎসল আর পর্যটকবান্ধব, সোজা কথায় শিল্প বান্ধব।