কালের সাক্ষী হয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আজও দাঁড়িয়ে সতীদাহ মন্দির
ইতিহাসের অমানবিক ও বীভৎস এক প্রথা- সীতাদাহ।আদি ত্রিপুরায়ও সতীর জ্যান্ত শরীর পুড়েছে। এর বেশিরভাগই জোর করে নারীকে স্বামীর চিতায় জ্যান্ত দাহ করার ঘটনা। প্রথা মান্য করে স্বেচ্ছায় স্বামীর চিতার আগুনে জীবন্ত দাহ হয়ে সহমরণের ঘটনাও অনেক নারীর। অবিভক্ত ত্রিপুরার ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ঠিক কয়টি স্থানে সদ্য বিধবা নারীকে স্বামীর চিতায় জ্যান্ত পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বা
নিজেই জ্যান্ত দাহ হয়েছেন তার সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি। তবে জেলার নবীনগর উপজেলার বিদ্যাকুট গ্রামে সড়কের পাশে কালের সাক্ষী হয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে একটি সতীদাহ মন্দির।
প্রায় তিনশো বছরের পুরানো মন্দিরটি জানান দিচ্ছে এই অঞ্চলে নারীর প্রতি অমানবিক ও বীভৎস সেই প্রথার। সম্প্রতি নবীনগর উপজেলা প্রশাসন মন্দিরটি আদিরূপ পরিবর্তন করে সংস্কার করেছে।এ নিয়ে প্রতিবাদ হওয়ায় আবারও আলোচনায় আসে এই সতীদাহ প্রথা ও মন্দির। সেই সঙ্গে নারীর প্রতি অমানবিক আচরণের বিষয়টিও।জেলার ইতিহাসবিদ, সাংস্কৃতিককর্মী, সাংবাদিক ও নাগরিক ফোরামের নেতারা বলছেন সংরক্ষণের দাবি দীর্ঘদিনের।তবে মন্দিরের আদি রূপ পরিবর্তন করে যে সংস্কার হয়েছে তা বেমানান। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা নাগরিক ফোরামের সভাপতি ও সাংবাদিক পীযূষ কান্তি আচার্য দৈনিক সংবাদকে বলেছেন,ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়একাধি স্থানে সতীদাহ হয়েছে।একটি মন্দির কালের দীক্ষা হয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে নবীনগরে।আরও যে কয়টি ছিল সবকটির খোঁজ করে সংরক্ষণ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ইতিহাস সংরক্ষণের জন্যই প্রয়োজন৷ব্রাহ্মণবাড়িয়া জাদুঘরের স্বপ্নদ্রষ্টা ও লোকজ সংস্কৃতির গবেষক জহিরুল ইসলাম চৌধুরী স্বপন গণমাধ্যমকে বলেছেন,এই মন্দিরটি সাড়ে তিনশ বছরের বেশি পুরানো।সাধারণত প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ একশ বছরের পুরানো এ ধরনের স্থাপনাকে সংরক্ষণ করে থাকে। কিন্তু এটিকে এখনও পর্যন্ত পুরাকীর্তি হিসাবে সংরক্ষণ করা হয়নি। মন্দিরটি এই এলাকার ইতিহাস,ঐতিহ্য ও অস্তিত্বের সাথে মিশে আছে জানিয়ে তিনি বলেন, না বুঝে সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে অপরিকল্পিত সংস্কার করার কারণে মূল্যবান এই নিদর্শনটির আদিরূপ ও ঐতিহাসিক গুরুত্ব নষ্ট হয়েছে। চুনকাম করার কারণে পুরানো এই স্থাপনাটির প্রাচীনত্ব বোঝার উপায় নেই। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা শহর থেকে প্রায় বারো কিলোমিটার পশ্চিমে এবং নবীনগর উপজেলা সদর থেকে পনেরো কিলোমিটার পূর্বদিকে বিদ্যাকুট গ্রামের দক্ষিণ প্রান্তে মন্দিরটির অবস্থিত। বিদ্যাকুট বাজার থেকে মেরকুটা বাজার যাতায়াতের আঞ্চলিক সড়কের কিনারও সড়ক সংলগ্ন খাল পাড়েই মন্দিরটির অবস্থান। নবীনগর উপজেলা সদর থেকে রিকশা নিয়ে মন্দিরটিতে আসা যায়। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা তথ্য বাতায়নে (জেলা প্রশাসনের অনলাইন পোর্টাল) উল্লেখ আছে, বিদ্যাকুট গ্রামের প্রসিদ্ধ হিন্দু জমিদার দেওয়ান বাড়ির বাসিন্দা দেওয়ান রাম মানিক এটি নির্মাণ করেছিলেন। তারা ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর গ্রাম ছেড়ে ভারতে চলে যান।জানা যায়, ব্রিটিশ শাসনামলে কলকাতার বিখ্যাত সাংবাদিক অনিলধন ভট্টাচার্যের জন্ম এই বিদ্যাকুট গ্রামে। অনিলধন ভট্টাচার্য রচিত ‘শাশ্বত ত্রিপুরা’ গ্রন্থে এই সতীদাহ মন্দিরের কথা উল্লেখ রয়েছে।
এই গ্রন্থে বিদ্যাকুট গ্রামটিকে ত্রিপুরা রাজ্যের নবদ্বীপ বলা হতো উল্লেখ আছে।গ্রামে অনেক বিখ্যাত সাধু- সন্তের জন্ম হয়েছিল বলেই এমনটি বলা হতো।এই গ্রামের দেওয়ান বাড়ির লোকেরা সতীদাহ মন্দির নির্মাণ করেন। বিদ্যাকুট ছাড়াও আশ পাশের মেরকুটা,সেমন্তঘর, শিবপুর ও বাঘাউড়া গ্রামের হিন্দুদের নিজস্ব কোন সতীদাহ মন্দির না থাকায় তারাও এই মন্দির ব্যবহার করতো। পরে গ্রামে শিক্ষার প্রসারের কারণে উঠতি হিন্দু শিক্ষিত যুবকেরা
বিশেষ করে জমিদার ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তানরাই এই অমানবিক প্রথাটির বিরোধিতা করেন।১৮২৯ সালে তৎকালীন বাংলার গভর্ণর লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক আইন করে সতীদাহ প্রথা বন্ধ করে দিলেও এই গ্রামের মন্দিরে গোপনে দাহ করা হয়। এমনটি হয়েছে আরও অনেক বছর। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার লোকজ সংস্কৃতির গবেষক জহিরুল ইসলাম চৌধুরী স্বপন ১৯৮০ সালের দিকে বিদ্যাকুট গ্রামের গৃহবধূ বনলতা দেবীর কাছ থেকে ব্রিটিশ সরকারের একটি চিঠি সংগ্রহ করেন। তৎকালীন ত্রিপুরা রাজ্যের রাজার কাছে পাঠানো সতীদাহ প্রথা বন্ধের নির্দেশ ছিল। জেলা তথ্য বাতায়নে আরও বলা আছে,এদেশে হিন্দু সমাজে যখন সতীদাহ প্রথার প্রচলন ছিল, তখন স্বামী মারা গেলে স্ত্রীকে তার সঙ্গে জীবন্ত দাহ করা হতো।
কোনও কোনও ক্ষেত্রে সদ্য বিধবারা স্বেচ্ছায় মৃত্যুবরণ অথবা ‘সহমরণ’ করতো। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই জোরপূর্বক দাহ করা হতো। জীবন্ত সতী নারীর বেঁচে থাকার আর্তনাদ যেন না শোনা যায় সেজন্য খুব জোরে ঢাক এবং বাদ্যযন্ত্র বাজানো হতো। ১৮৩৫ সালে রাম মানিকের মাকে এই মন্দিরটিতে সর্বশেষ সতীদাহ বরণকারী হিসাবে উল্লেখ করে শ্বেত পাথরের একটি নামফলক বসানো হয়েছিল। ১৯৭১ সালে সংঘটিত মুক্তিযুদ্ধের সময় এটি বিনষ্ট হয়। বর্তমানে বিদ্যাকুট গ্রামে রাম মানিকের বংশধরদের কেউ না থাকায় সেই সতী নারীর নাম জানা যায়নি।ব্রাহ্মণবাড়িয়া সাহিত্য একাডেমির সভাপতি কবি জয়দুল হোসেন বলেছেন, প্রায় দুইশ বছর আগে অবৈধ ঘোষিত সতীদাহ প্রথার মন্দিরটি বর্তমান প্রজন্মকে ধর্মীয় রীতির সেকাল-একাল অনুধাবনের সুযোগ করে দেয়। তাই মন্দিরটি সংরক্ষণ জরুরী। বিদ্যাকুট গ্রামের বাসিন্দা ও প্রাপ্তন ইউপি সদস্য মো. ছানাউল্লাহ সাংবাদিকদের জানান, কালের আবর্তে তাদের গ্রামে বসবাসরত সম্ভ্রান্ত হিন্দু পরিবারের অধিকাংশ লোকই দেশত্যাগ করেন।যে পরিবার এই মন্দির নির্মাণ করেছিলেন তারাও বহু আগে দেশ ত্যাগ করেছেন।মন্দির নির্মাণকারীদের উত্তরসূরি যারা তাদের ভিটেমাটি এখন সরকারের অর্পিত সম্পত্তি।তবে এখনও টিকে আছে মন্দিরটি। দীর্ঘদিন প্রাচীনতম এই মন্দিরটি পরগাছায় আচ্ছাদিত ছিল।নবীনগরের সাংস্কৃতিক কর্মী ও সাংবাদিক গৌরাঙ্গ দেবনাথ অপু দৈনিক সংবাদকে বলেছেন, নতুন প্রজন্মের অনেকেই জানে না সতীদাহ প্রথা কী। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে নারীদের প্রতি নিষ্ঠুর বর্বরতা, অন্যায়-অবিচারের প্রথা সতীদাহ প্রথা সেই কালো অধ্যায় সম্পর্কে জানাতে প্রাচীন এই মন্দিরটি আদিরূপ অক্ষুন্ন রেখে এর রক্ষণাবেক্ষণ করা প্রয়োজন।