অথ: রিজিজু কথা

 অথ: রিজিজু কথা
এই খবর শেয়ার করুন (Share this news)

কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার মন্ত্রীদের মধ্যে আইনমন্ত্রী কিরেন রিজিজু ছিলেন প্রধানমন্ত্রী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সবচেয়ে নয়নের মণি অর্থাৎ যাকে কিনা বলা হয় “ব্লু আইড বয়”- রাজনীতির অলিন্দে এমনটাই প্রচার ছিল গত কয়েক বছরে।এরকম একজন পছন্দের পাত্রকে কার্যত আচমকাই তার পদ থেকে হটিয়ে দিলেন প্রধানমন্ত্রী বৃহস্পতিবার। আইনমন্ত্রকের দায়িত্ব থেকে পছন্দের রিজিজুকে শুধু সরানোই নয়,তাকে নতুন করে এমন এক জায়গায় পাঠালেন ‘ভূ-বিজ্ঞান মন্ত্রক’ – যার নাম শুনেই রাজনীতিক মহলে কানাঘুসো শুরু হয়েছে।এ যেন অনেকটা রাজনীতিবিদদের কাছে স্বর্গ থেকে পতন। রিজিজু উত্তর-পূর্বের রাজ্য অরুণাচলের সাংসদ হলেও জাতীয় রাজনীতিতে তার উত্থান এবং প্রভাব ছিল রীতিমত ঈর্ষণীয়। একদিকে সরকারের সবচেয়ে সফল এবং গুণী মন্ত্রী হিসাবে পরিচিত নীতিন গড়কড়িকে যখন কার্যত গুরুত্বহীন করতে করতে দল ও সরকারে অপ্রাসঙ্গিক করে তোলা হয়েছে। ঠিক তার পাশাপাশি রিজিজু যুব কল্যাণ ও ক্রিড়ামন্ত্রকের দায়িত্ব থেকে সরাসরি দেশের আইনমন্ত্রী পদে পদোন্নতি পাওয়া মানেই মোদি- শাহর কতটা আস্থাভাজন ও বিশ্বস্ত হতে পেরেছেন সেটা খুব সহজেই অনুমেয়। অথচ কিরেন রিজিজুই বিগত বেশকিছু সময় ধরে কেন্দ্রীয় আইমন্ত্রী পদে আসীন হওয়ার পর এমন সব বক্তব্য ও ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন,যা দেশের বিচার ব্যবস্থার সঙ্গে সরকারের সংঘাত শেষ বিন্দুতে নিয়ে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল।ওয়াকিবহাল মহল বলছেন,বিভিন্ন সময়ে কেন্দ্রীয় সরকার বিভিন্ন সংস্থা ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের উপর নিজেদের ১০০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ আরোপ করলেও,বিচার ব্যবস্থার উপর এত সাঁড়াশি আক্রমণ এবং প্রকাশ্য বিচার ব্যবস্থার এক্তিয়ারকে প্রশ্নচিহ্নের মুখে ঠেলে দেওয়ার নজীর ইতিপূর্বে আর কখনও ঘটেনি,যেমনটা আইনমন্ত্রী কিরেন রিজিজু করেছেন।কলেজিয়াম পদ্ধতিতে বিচারক নিয়োগ নিয়ে সরকারের সঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের বিরোধ মোদি জমানায় অনেক আগে থেকেই শুরু হয়েছিল।সরকার বর্তমানে চালু কলেজিয়াম পদ্ধতি বাতিল করে ন্যাশনাল জুডিশিয়াল অ্যাপয়েন্টমেন্ট কমিশন আইন প্রণয়ন করেছিল। কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট সরকারের এই পদ্ধতি বাতিল করে কলেজিয়াম পদ্ধতিতে বিচারক নিয়োগ জারি থাকবে বলে জানায়।মোদি সরকার দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার পর ফের একবার কলেজিয়াম পদ্ধতিতে বিচারক নিয়োগ প্রক্রিয়া বাতিল করতে উঠে পড়ে লাগে।রিজিজু বললেন,স্বাধীনতার পর দেশের অনেক ব্যবস্থা পরিবর্তন হয়েছে। তাই কলেজিয়াম পদ্ধতিটি এখন পরিবর্তন প্রয়োজন।রিজিজুর পক্ষে এবার মঞ্চে অবতীর্ণ হলেন লোকসভার অধ্যক্ষ ওমন বিড়লা এবং উপরাষ্ট্রপতি ধনখড়।দেখা গেল এরপর, কলেজিয়াম পদ্ধতিতে বিচারপতি নিয়োগের জন্য সুপ্রিম কোর্ট যে নামের সুপারিশ করছে,কেন্দ্রীয় সরকার সেই তালিকায় অনুমোদনের কাজটি ঝুলিয়ে রাখছে।এই সংঘাত যখন তীব্র, তখন আইনমন্ত্রী রিজিজু বলছেন, বিচারপতিরা কী বিচার করছেন তা দেশের জনতা নজর রাখছে। যেহেতু বিচারপতিরা ভোটে দাঁড়ান না তাই তাদের কানও দায়বদ্ধতা নেই বলেও কটাক্ষ করেন রিজিজু।এতে বিরক্ত সুপ্রিম কার্ট আইনমন্ত্রী রিজিজু এবং উপরাষ্ট্রপতি ধনখড়কে কলেজিয়াম বিতর্কে সংযত আচরণ করতে নির্দেশ দেয়। দেখা গেল বাদবাকিরা নিজেদের গুটিয়ে নিলেও আইনমন্ত্রী রিজিজু ফের হুংকার ছাড়লেন বিচারব্যবস্থার দিকে।বললেন জনগণই দেশের শেষ কথা। আইনমন্ত্রীর এই বক্তব্য কার্যত বিচারব্যবস্থার এক্তিয়ার নিয়েই প্রশ্ন তোলার নামান্তর।দেখা গেল আইনমন্ত্রীর এই বক্তব্যের পর দেশের সর্বোচ্চ আদালতের প্রধান বিচারপতিও ঘোষণা করেন,দেশে সংবিধান হল সবার উপরে।আর সেই সংবিধান মেনেই কাজ করছে সুপ্রিম কোর্ট।
মূলত বিচারব্যবস্থা বনাম কেন্দ্রীয় সরকারের চলমান এই বিরোধে রিজিজু ছিলেন সামান্য একটা প্রতীকি মুখ মাত্র।কারণ দীর্ঘদিন ধরেই বর্তমান কেন্দ্ৰীয় সরকার বিচারপতি নিয়োগে নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করতে চাইছিল।আর রিজিজুকে আইনমন্ত্রকে এনে ‘অদৃশ্য কিছু মুখ’ তাদের তৈরি করা স্ক্রিপ্টেই রিজিজুকে দিয়ে বিচারব্যবস্থার বিরুদ্ধে লাগামহীন আক্রমণে নেমেছিল। কারণ অতীতেও রামমন্দির নিয়ে কী ধরনের রায় হওয়া উচিত পরোক্ষে সেরকম লক্ষ্মণ রেখাও এঁকে দেওয়া হয়েছিল।কিন্তু জট দেখা দিয়েছে দেশের বর্তমান প্রধান বিচারপতির কঠোর ও দৃঢ় অবস্থানকে ঘিরে।সংবিধানের গন্ডীর বাইরে গিয়ে কোনওভাবেই যে তিনি বা বিচারব্যবস্থা চালিত হতে চায় না সাম্প্রতিক শীর্ষ আদালতের কিছু পর্যবেক্ষণ এবং রায়েই সেটা স্পষ্ট হয়ে আছে। আর তাতেই কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে সংঘাতের আবহে সুপ্রিম কোর্ট যে তার অবস্থান ও কঠোর দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সরছেন না—তার বার্তা আগামী দিনের জন্য যে দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও পরিমণ্ডলে দেশের শাসকশক্তির পক্ষে স্বস্তির নয় সেটা অনুধাবন করতে পেরেই মঞ্চে অদৃশ্য কুশীলবরা আচমকাই আইনমন্ত্রীকে তার পদ থেকে সরিয়ে নিতে বাধ্য হলেন। বিশ্লেষকরা বলছেন,আদানি মামলা সহ অন্তত ৮/১০টি এমন সংবেদনশীল মামলা বর্তমানে সুপ্রিম কোর্টের টেবিলে আছে যার রায় দেশের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে বড়সড় ভূমিকা নিতে পারে।দেশের বর্তমান প্রধান বিচারপতির কার্যকালের মেয়াদ ২০২৪-এর নভেম্বর মাস পর্যন্ত। ততদিনে দেশের লোকসভা নির্বাচনের ফাইনাল অনুষ্ঠিত হয়ে যাবে। তাই এই জটিল আবহে আচমকা কিরেন রিজিজুর অপসারণ দেশে কর্ণাটকের নির্বাচনোত্তর পরিস্থিতিতে যুযুধান দুই শিবিরের লড়াইয়ের মধ্যে শ্বেত পতাকা তুলে কেন্দ্রের তরফে সন্ধির প্রস্তাবেরই প্রয়াস বলে মনে করা হচ্ছে। কিন্তু তাতে আদৌ বরফ কতটা গলবে।তা আগামীদিনেই স্পষ্ট হবে।তবে যে মোদি-শাহ জুটি সব ইস্যুতেই দূর্বার গতিতে এগিয়ে চলার মন্ত্র নিয়ে চলেন,তাদের এই আচমকা পিছিয়ে আসাটা যে যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ, সেটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়।

Dainik Digital

Dainik Digital

Leave a Reply

Your email address will not be published.