সম্পর্কের মেরামতি।

 সম্পর্কের মেরামতি।
এই খবর শেয়ার করুন (Share this news)

হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত শান্ত সৌম্য প্রতিবেশী দেশ নেপাল।বরাবরই ভারত ও নেপালের মধ্যে সম্পর্ক ছিল সৌহার্দ্যের, বন্ধুত্বের এবং আত্মীয়তার।সেই সূত্র ধরে রাজতান্ত্রিক নেপালের গণতন্ত্রে উত্তরণের হাত ধরে দুই দেশের মধ্যে সময়ের বিবর্তনে সম্পর্ক আরও নিবিড় হয়েছে,মজবুত হয়েছে। ১৯৯৭ সালের আগে পর্যন্ত ভারত ও নেপালের রাষ্ট্রপ্রধানেরা নিয়মিত একে অপরের আত্মীয়ের মতোই প্রতিবেশী দুই দেশে সফর করতেন।এটা ছিল ভারত আর নেপালের মধ্যে দীর্ঘ ঐতিহ্য ও রীতি পরম্পরার মেলবন্ধন।কিন্তু বিভিন্ন কারণে এই সময়ের পর থেকেই উভয় দেশের মধ্যে সম্পর্কের টানাপোড়েন শুরু হয়। এর পেছনে অন্যতম প্রধান কারণ হিসাবে চিনের আগ্রাসী কূটনৈতিক চাল এবং নেপালের আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে চিনের মাত্রাতিরিক্ত দখলদারি বড় ভূমিকা নিতে শুরু করে।শুরুতে নেপালের মাওবাদী নেতা পুষ্পকমল দহল ওরফে প্রচণ্ড, তিনিও ছিলেন চিনঘেঁষা উগ্র ভারতবিদ্বেষী ভাবধারায় পরিচালিত।কিন্তু নেপালে দিনের পর দিন চিন যেভাবে আধিপত্য ও নিয়ন্ত্রণ আরোপের চেষ্টা করছিল,তা পাছে একসময় গোটা নেপালকেই চিনের উপনিবেশ হিসাবে গড়ে না ওঠে এই আশঙ্কা প্রচণ্ডের মনেও বদ্ধমূল হতে শুরু করে।আর এই প্রেক্ষাপটেই চারদিনের ভারত সফরে এসেছেন নেপালের প্রধানমন্ত্রী। মাত্র গত বছরই অর্থাৎ ২০২২ সালের ডিসেম্বরে নেপালের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পান তিনি। ঠিক এর পরই পাঁচ মাসের মাথায় প্রচণ্ডর দিল্লী সফর যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ।

আরও গুরুত্বপূর্ণ দিক হল, প্রচণ্ডর দিল্লী সফর শুরুর মাত্র চব্বিশ ঘন্টা আগে নেপালের রাষ্ট্রপতি রামচন্দ্র পাউডেল সেদেশের নাগরিকত্ব আইনের একটি বিতর্কিত সংশোধনীতে সম্মতি দিয়েছেন। এই সংশোধনীতে বলা হয়েছে, কোনও নেপালের নাগরিককে বিয়ে করলে এখন থেকে সেই বিবাহিত বিদেশি মহিলা নেপালের নাগরিক হিসাবে গণ্য হবেন। বিবাহসূত্রে বিদেশি মহিলার নেপালি নাগরিকত্ব অর্থাৎ রাজনৈতিক অধিকারের নিশ্চয়তা চিনের জন্য কোনওভাবেই সুখের খবর নয়। কেননা এতদিন চিনের চাপেই এই সংশোধনীতে সম্মতি নিতে পারেননি নেপালের রাষ্ট্রপতি বিদ্যাদেবী ভাণ্ডারী।অথচ নেপালে সরকার বদলের পর প্রচণ্ড প্রধানমন্ত্রী পদে ক্ষমতাসীন হতেই বর্তমান রাষ্ট্রপতি নাগরিকত্ব সংশোধনীতে সম্মতি দিতে বাধ্য হলেন।চিনের ভয়ের কারণ হলো, এই সংশোধিত আইন তিব্বতি উদ্বাস্তুদের বংশধরদের নেপালে নাগরিকত্ব এবং সম্পত্তির অধিকার দিতে পারবে।যা চিনের জন্য কোনওভাবেই স্বাচ্ছন্দ্যের বার্তা নয়। তাই চিন বরাবরই নেপালকে নিজের কুক্ষিগত রাখতে একদিকে ভারতবিরোধী জিগির এবং অপরদিকে তিব্বতীদের নেপালে আস্তানা আটকাতে নেপালের উপর চাপ সৃষ্টি করে চলেছিল।নেপালে চিনের ক্রমবর্ধমান আগ্রাসী উপস্থিতি সম্পর্কে ভারত যথেষ্ট অবহিত থাকলেও ২০১৯ সাল থেকে নেপাল যেভাবে ভারতের সঙ্গে সীমান্ত বিতর্কে জড়িয়ে গেছে, বিশেষ করে লিম্পিয়াধুরা, লিপুলেখ, কালাপানি মানচিত্র সংঘাতকে ঘিরে যে অস্থির পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল এর ব্যাপকতা যে এতটা ছড়াতে পারে সেটা নেপালের রাজনৈতিক মহলের ধারণার বাইরেই ছিল। নেপালের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা অলির তত্ত্বাবধানে ভারত সরকার এই সমস্যাগুলোর নিরসনে বারংবার চেষ্টা চালালেও তার কোনও সুনির্দিষ্ট ফলাফল পাওয়া যায়নি। যদিও পরবর্তী পর্যায়ে নেপালে সরকারের পালাবদল এবং প্রচণ্ডর ক্ষমতায় ফিরে আসার মধ্য দিয়েই নেপাল সরকার উপলব্ধি করতে শুরু করে চিনের ইশারায় ভারতবিরোধী চক্রান্ত নেপালের অত্যধিক ভূমিকা আগামী দিনে নেপালের জন্য যথেষ্ট মূল্য দিতে হতে পারে।

কেননা,নেপালকে ভারতের বিরুদ্ধে খেপিয়ে তুলে কৌশলে চিন নেপালকেই নিজের উপনিবেশ হিসাবে গড়ে তুলতে পারে। নেপালের এই শুভবুদ্ধি উদয়ের মধ্য দিয়ে ভারত সরকারও ‘নেবারহুড ফার্স্ট পলিসি’ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে নেপালকে সহযোগিতার জন্য এবং চিনের বেড়াজালে যেভাবে শ্রীলঙ্কা পাকিস্তান জড়িয়ে গেছে, সেই একইভাবে এর থেকে নেপালকে বের করে নিয়ে আসার প্রয়াস শুরু করে ভারত।এরই বহিঃপ্রকাশ হিসাবে ভারত- নেপাল দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক ও সংযোগ উদ্যোগের থমকে থাকা বিষয়গুলো সমাধানের ইঙ্গিত দিতে দিল্লী সফরে এসেছেন প্রচণ্ড।ভৌগোলিক অবস্থানের নিরিখে নেপালের কাছে ভারতের সঙ্গে সৌহার্দ্য ও সুসম্পর্ক বজায় রাখা বেশি গুরুত্বপূর্ণ।এই বাস্তবতা উপলব্ধি করেই উভয় দেশই রাজনৈতিকভাবে নতুন উদ্যোগে একজোটে কাজ করার যে কর্মসূচি নিয়েছে তা প্রচণ্ডের দিল্লী সফরে ভারত-নেপালের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক আরও মজবুত করার চেষ্টা অবিরাম গতি পাবে। এর ইঙ্গিতও মিলতে শুরু করেছে।প্রচণ্ডের সফরে ভারতের সঙ্গে নেপালের সুসম্পর্কের বার্তা দিতে আগামী কিছুদিনের মধ্যেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিরও কাঠমাণ্ডু সফরের কর্মসূচি চূড়ান্ত হয়েছে। সব মিলিয়ে প্রচণ্ডের এই ভারত সফর দিল্লী-কাঠমাণ্ডুর মধ্যে নতুন রাজনৈতিক মানচিত্র নির্মাণের অগ্রযাত্রা সেটা নিঃসন্দেহে বলা যায় ।

Dainik Digital

Dainik Digital

Leave a Reply

Your email address will not be published.