স্পর্ধিত সমারোহণ।

 স্পর্ধিত সমারোহণ।
এই খবর শেয়ার করুন (Share this news)

ইমারত যতই সুউচ্চ হোক তা কখনোই গগনভেদী হতে পারে না। তেমনই সংখ্যার জেরে ক্ষমতা নিজেকে অনতিক্রম্য মনে করলেও তা সংবিধানভেদী হতে পারে না। ক্ষমতা যখনই ক্ষমতান্ধ হয়ে সংবিধানকে আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে রাঙাতে চায়, দেশের ইতিহাস সাক্ষী, সুপ্রিম কোর্ট ছেড়ে কথা বলে না। ক্ষমতা এই সত্য জানে বলেই তাদের মধ্যে কিঞ্চিৎ চক্ষুলজ্জা কাজ করে। সেই লজ্জাটুকুই দেশবাসীর ভরসা। কিন্তু যখন সেই লজ্জাও ক্ষয়িষ্ণু হতে শুরু করে অর্থাৎ সংসদের গণ্ডিকেও তোয়াক্কা করে না, তখন দেশবাসীর কাছে শেষ আশ্রয়স্থল হিসাবে পড়ে থাকে বিচারের বাণী।দেশের সংবিধান রক্ষার প্রশ্নে এমনই গুরুত্বপূর্ণ এবং রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত সংবেদনশীল দুটি মামলা সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ধনঞ্জয় যশবন্ত চন্দ্রচূড় শুনবেন চলতি মাসেই।একটি দিল্লীর কেজরিওয়াল সরকারের বিরুদ্ধে আনা কেন্দ্রের অধ্যাদেশ সংক্রান্ত এবং অন্যটি মহারাষ্ট্রে উদ্ধব ঠাকরের নেতৃত্বাধীন শিবসেনার অঙ্গচ্ছেদের মামলা। প্রথম মামলাটি শুনানির কথা আগামী ১৭ জুলাই, দ্বিতীয়টি ৩১ জুলাই। গণতন্ত্রে বিরোধী পরিসরের গুরুত্ব অপরিসীম। এই দুই মামলাই মোদি সরকারের নীতি- নৈতিকতাকে চ্যালেঞ্জ করে বিরোধী তরফে দায়ের করা। দুটি মামলাই আদপে ক্ষমতার স্পর্ধিত সমারোহণের পাল্টা চ্যালেঞ্জ।
দিল্লীর নির্বাচিত সরকারে আমলা নিয়ন্ত্রণের রাশ কার হাতে থাকা উচিত,রাজ্য সরকার নাকি কেন্দ্রীয় সরকার তথা দিল্লীর উপরাজ্যপাল ? প্রশ্নের প্রতিকার চেয়ে কেজরিওয়াল দেশের মহামান্য প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচূড়ের শরণাপন্ন হন। প্রধান বিচারপতি সেই মামলা শোনেন এবং রায় দেন, এবার থেকে দিল্লীর মুখ্যমন্ত্রী তার আমলাদের বদলি ও নিয়োগ করতে পারবেন, কেন্দ্র সেখানে কোনও হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। সেই রায় মান্য করার বদলে মোদি সরকার পাল্টা একটি অধ্যাদেশ (অর্ডিন্যান্স) নিয়ে এসে দিল্লীর মুখ্যমন্ত্রীর হাত থেকে সেই ক্ষমতা কুক্ষিগত করে নিয়েছে। কেন্দ্রের এহেন পদক্ষেপকে চ্যালেঞ্জ করে সোমবার কেজরিওয়ালের আইনজীবী প্রধান বিচারপতির দরজায় কড়া নাড়েন। প্রধান বিচারপতি মামলা গ্রহণ করে জানান, আগামী ১৭ তারিখ তিনি এই মামলা শুনবেন। দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো বিন্যাসের প্রশ্নে এই মামলার পরিণতির গুরুত্ব সুদূরপ্রসারী। দ্বিতীয় মামলার গুরুত্বটিও সমধিক।এই মামলার প্রতিপাদ্য, রাজ্যের নির্বাচিত সরকারকে ভেঙে দেওয়ার চক্ষুলজ্জাহীন স্পর্ধা। মহারাষ্ট্রে নিছক ঘোড়া কেনাবেচা করে বিরোধীদের জোট সরকার পাল্টে দেওয়া হয়নি, পর্যায়ক্রমে দুইবার নির্লজ্জভাবে গোটা আস্তাবল কিনে নেওয়া হয়েছে। জনতার রায়কে নিজেদের খেয়ালখুশি মতো চেলে নেওয়ার এই প্রণবতা শাসকদল ত্যাগ করবে, সে আশা ক্ষীণ। গণতন্ত্রের পথেই এর প্রতিরোধ কাম্য ছিল। কিন্তু মহারাষ্ট্রের ঘটনাক্রম বুঝিয়ে দিয়েছে, জোট রাজনীতির কুশীলবেরা অতীতের কালিমা, দুর্নীতির আকণ্ঠ পাঁক থেকে বেরিয়ে সেই প্রতিরোধ গড়ে তোলার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছেন। অর্থ এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের পরাক্রমের সামনে মহারাষ্ট্রে বিরোধী জোটের অসহায় আত্মসমর্পণ প্রমাণ করে, ভারতবর্ষে আপসহীন, নির্ভীক রাজনীতি এখন এক অস্তমিত সূর্য। কিন্তু গণতন্ত্রের পাঠ, সংবিধান রক্ষার পাঠ এক বহমান নদী। বাঁধ দিয়ে গতিপথ আটকানো নয়, বরং সেই নদী থেকে পলি তুলে তার প্রবাহকে বাধাহীন করে তোলাই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের করণীয়। কিন্তু মহারাষ্ট্রে অর্থ এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের হুঙ্কারে যে কায়দায় শিবসেনার অঙ্গচ্ছেদ ঘটানো হয়েছে এবং ততোধিক তৎপরতায় দেশের নির্বাচন কমিশন উদ্ধব ঠাকরের হাত থেকে দলের প্রতীক কেড়ে নিয়ে তা খণ্ডিত শিবসেনার নেতা একনাথ শিণ্ডের হাতে তুলে দিয়েছে, তা কি ভারতীয় সংবিধানের অনুপন্থী? আগামী ৩১ তারিখ সেই মামলাই শুনবে প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চ। চলতি মাসে এই দুই মামলার রায় যদি শাসকের অনুকূলে না যায়, চব্বিশের লোকসভা নির্বাচনকে তা প্রভাবিত করতে বাধ্য।তাই গগনভেদী ইমারত গড়ার দুঃসাহস দূরে সরিয়ে সংবিধানের প্রতি প্রণিপাত হয়ে থাকাই শাসকবর্গের শ্রেয়।

Dainik Digital

Dainik Digital

Leave a Reply

Your email address will not be published.