আপনি আচরি ধর্ম….

 আপনি আচরি ধর্ম….
এই খবর শেয়ার করুন (Share this news)

শ্রাবণস্য প্রথম দিবসে যুযুধান দুই রাজনৈতিক শিবিরে দুটি উল্লেখযোগ্য কাহিনি রচিত হয়েছে। এদিকে ছাব্বিশটি বিরোধী রাজনৈতিক দলের সম্মিলনে ইন্ডিয়া নামক একটি জোট ভূমিষ্ঠ হয়েছে, অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির পৌরোহিত্যে আটত্রিশটি দল নিয়ে মৃতপ্রায় এনডিএ জোটের গলায় সঞ্জীবনী জোটের ঢালা হয়েছে।টেকনিক্যালি তিনটি পায়ায় দাঁড়িয়ে থাকে রাজনীতি। এক)অপটিক্স বা আলোকবিজ্ঞান,যা দৃশ্যের জন্ম দেয়, (দুই) ডায়নামিক্স বা গতিবিজ্ঞান, যা জনমানসে গতি সঞ্চার করে এবং (তিন) স্পেকট্রাম বা বর্ণালী, যা চালচিত্র তৈরি করে। অতএব চব্বিশের লোকসভা নির্বাচনকে পাখির চোখ করে ভাঙা-গড়ার খেলায় এই দৃশ্যপটও বদলে যেতে পারে। তবে ওইদিন পার্টব্লেয়ারের বীর সাভারকর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নতুন ভবন উদ্বোধনে সাড়ে চব্বিশ মিনিট নিজের ভিডিও বক্তৃতার মধ্যে উনিশ মিনিট ধরে প্রধানমন্ত্রী যে রণংদেহি শরীরী ভাষায় কংগ্রেস সহ বিরোধীদের আক্রমণ করলেন, তা বেশ কিছু প্রশ্ন উসকে দিয়েছে। মূলত পরিবারতন্ত্র, দুর্নীতি নিয়ে সেদিন তিনি বিরোধীদের বিদ্ধ করেন। জোট শরিকদের নীতি-নৈতিকতাকে কাঠগড়ায় তোলেন। রাজ্যস্তরে একে অপরে কুস্তিতে লিপ্ত হয়েও জাতীয় স্তরে দোস্তির ঔচিত্য নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। বিরোধীদের সম্বন্ধে বলেন, দলের মীদের প্রতি তাদের কোনও দায়বদ্ধতা নেই, তারা কেবল নিজের স্বার্থ চরিতার্থে মগ্ন।প্রধানমন্ত্রীর ওই বক্তব্য শুনে অনেকেরই সম্ভবত বাংলা ভাষায় অতি চলিত আপ্তবাক্যটি মনে এসেছে।কারণ মানুষ অনেক কিছু ভুলে গেলেও আবার বহু কিছু তার স্মৃতিতে সতেজ থাকে। বিহারে যে বিজেপি কার্যকর্তারা নীতীশ কুমারকে পরাজিত করতে প্রাণপাত করেও ব্যর্থ হয়েছিলেন, তাদের শ্রম তুচ্ছ করে প্রধানমন্ত্রী কেন সেই নীতীশ কুমারেরই হাত ধরেছিলেন? আসামের নির্বাচনে যে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে বিজেপির কার্যকর্তারা মাঠে ময়দানে লড়াই করেছিলেন, সেই কংগ্রেস থেকেই কেন হিমন্ত বিশ্বশর্মাকে দলে টেনে সটান মুখ্যমন্ত্রীর গদিতে বসানো হল? একইভাবে মহারাষ্ট্রের কোপরি-পাচপাখাড়ি বিধানসভা আসনে শিবসেনার যে বাহুবলী নেতাকে হারাতে গেরুয়া কর্মীরা গলা ফাটিয়েছিলেন, তাদের আবেগ অগ্রাহ্য করে কেন সেই একনাথ শিশুকে বুকে টেনে মুখ্যমন্ত্রীর কুর্সিতে বসানো হল?
একই কথা জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়ার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হতে পারে। যে আকালি ও শিবসেনা বিজেপির সবচেয়ে পুরানো মিত্র, তারা কেন দলের সঙ্গত্যাগ করল, বিজেপি কার্যকর্তারা সেই প্রশ্নও তুলতে পারেন।২০১৪ সালের পরে জম্মু কাশ্মীরে বিজেপির সমর্থন নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর গদিতে আসীন হন মুফতি মহম্মদ সঈদের কন্যা পিডিপি নেত্রী মেহবুবা মুফতি। মেহবুবা কি তখন পরিবারতন্ত্রের প্রতিভূ ছিলেন না? দিন কয়েক আগে প্রধানমন্ত্রী যার বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও পরিবারতন্ত্রের তীব্র বিষোদগার করেছিলেন, শারদ পাওয়ারের ভ্রাতুষ্পুত্র সেই অজিত পাওয়ারকে সাদরে উপমুখ্যমন্ত্রীর আসনে বসানো নৈতিকতার কোন অভিধানে পড়ে ? জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়া কোথা থেকে আজ কোথায়? জ্যোতিরাদিত্য সহ বিবেক ঠাকুর, উদয়নরাজে ভোঁসলে, লিশেম্বা সানাজোয়াবা, নবম রেবিয়া, নীরজ শেখর, সম্ভাজী ছত্রপতিরা অন্য দল থেকে পরিবারবাদেরই উৎপন্ন ফসল হয়ে আজ রাজ্যসভায় বিজেপির মনোনীত সদস্য। তেমনই পদ্ম প্রতীকে লোকসভায় জয়ী হওয়া অনুরাগ ঠাকুর, দুষ্যস্ত সিং, পুনম মহাজন, প্রীতম মুণ্ডে, প্রবেশ সাহিব সিং বর্মা, বি ওয়াই রাঘবেন্দ্ররা এই তন্ত্রেরই ধারক ও বাহক। লোকসভা ও রাজ্যসভা মিলিয়ে বিজেপির মোট ৩৮৮ জন সাংসদের মধ্যে ৮৫ জন, অর্থাৎ ১১ শতাংশ তথাকথিত পরিবারতন্ত্রের প্রতিনিধি। বঙ্গের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর মতো রাজ্যস্তরে এমন দৃষ্টান্ত অজস্র। প্রধানমন্ত্রী পরিবারবাদকে আক্রমণ করলেও কদাপি নিজের পুষ্করিণীর জল ঘোলা করেন না। ক্ষমতাকে পরাজিত করতে ভূমিষ্ঠ বিরোধীদের ছাব্বিশ দলের জোটকে তিনি যদি ‘নঞর্থক’ বলে দাগিয়ে দেন, তবে প্রতিপক্ষকে ধরাশায়ী করতে কোন যুক্তিতে আটত্রিশ দলের জোট ‘সদর্থক’ সে প্রশ্নও উঠে। সংসদকক্ষের ভিতরে বিরোধীদের উদ্দেশে এক মোদি সবপে ভারী’ বলা প্রধানমন্ত্রী কেন মৃতবৎ এনডিএ-র প্রাণসঞ্চারে ব্যগ্র হলেন সে প্রশ্ন নিরর্থক কারণ রাজনীতিতে অনেক কিছুই নিউটনের তৃতীয় সূত্র মেনে আবর্তিত হয়। তবে গত মাসেই আমেরিকার প্রেসিডেন্টের পাশে দাঁড়িয়ে যে প্রধানমন্ত্রী গণতন্ত্রের জয়গান গেয়েছিলেন এ দেশ সেই প্রধানমন্ত্রীর কাছে উদার গণতন্ত্রের মৌলিক শর্ত বাঁচিয়ে রাখারই প্রত্যাশা করে।সেই শর্তটি হল, বিরোধীদের রাজনৈতিক পরিসর তৈরির সুযোগ করে দেওয়া, সর্বগ্রাসী আধিপত্যবাদ কায়েম করে তাকে বিনষ্ট করা নয় ।

Dainik Digital

Dainik Digital

Leave a Reply

Your email address will not be published.