বিরোধের পিছনে দুর্নীতি, না অন্যকিছু? ছয়দিন ধরে অচল টিসিএ পুলিশি ভূমিকায় উঠছে প্রশ্ন।
অনলাইন প্রতিনিধি :- রাজ্য ক্রিকেটের অভিভাবক সংস্থা টিসিএর কর্তৃত্ব নিয়ে শাসকদলের দুই প্রভাবশালী গোষ্ঠীর মধ্যে প্রকাশ্যে এই ন্যক্কারজনক কাজিয়ার পিছনে মূলত কি কারণ? এই প্রশ্ন নিয়েই জনমনে প্রবল উৎসুক তৈরি হয়েছে। বিবাদমান দুই গোষ্ঠীই নিজেদের অবস্থানে অনড় থেকে দাবি করছে, তারাই সঠিক। সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে সকালে একপক্ষ তাদের বক্তব্য তুলে ধরছে। বিকালেই অপর পক্ষ তা খারিজ করে পাল্টা নিজেদের বক্তব্য তুলে ধরছে।এ নিয়ে জনমনে যেমন বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে, তেমনি রাজ্যের ক্রীড়া মহলেও নানা প্রশ্ন দানা বেঁধেছে। তবে অভিযোগ, পাল্টা অভিযোগ যাই থাক না কেন, দুই গোষ্ঠীর মধ্যে বিরোধের পিছনে প্রধান কারণ হচ্ছে টিসিএর কর্তৃপক্ষ নিজেদের হাতের মুঠোতে রাখা। তার সাথে যুক্ত হয়েছে চূড়ান্ত ইগো। সবাই এক দলের সৈনিক হলেও, কেউ কারও ছায়া পর্যন্ত সহ্য করতে রাজি নয়।এতে সংঘাত আরও চরমে উঠে। ক্ষমতা কুক্ষিগত করার উগ্র কামনা দুই প্রভাবশালী গোষ্ঠীকেই ক্রমশ চূড়ান্ত সংঘাতের পথে টেনে নিয়ে গেছে। এভাবেই ক্ষমতা আলগা হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দুই পক্ষকেই টেনে নামায় রাস্তায়। আলোচনার টেবিলে বসে অথবা আদালতের মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের পথে না হেঁটে, পেশি শক্তির আস্ফালনে মেতে উঠে। রাজ্য ক্রিকেটের অভিভাবক সংস্থায় এখন সেটাই চলছে।বিভিন্ন মহলের মতে, সব রাজ্যেই নানা সংস্থায় নানা ধরনের সমস্যা রয়েছে। কিন্তু ত্রিপুরা ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনে শাসকদলের দুই গোষ্ঠীর যে কাজিয়া, তা এককথায় নজিরবিহীন। রাজ্যে সরকার পরিবর্তনের পর টিসিএ নিয়ে তেমন কোনও ঝামেলার কথা শোনা যায়নি।বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী ডা. মানিক সাহা দীর্ঘ সময় টিসিএর সভাপতি হিসাবে কাজ করেছেন। তিনি মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর টিসিএর সভাপতির পদ তাকে ছাড়তে হয়েছে।মুখ্যমন্ত্রীর ছেড়ে আসা পদে বসানো হয় জনৈক তপন লোধকে।এরপর নিয়ম অনুযায়ী টিসিএর সাধারণ নির্বাচন ঘনিয়ে আসে।এই নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত হবেন টিসিএর অফিস বেয়ারার এবং অ্যাপেক্স কমিটি।এই নির্বাচন থেকেই শুরু হয় অশান্তি।সেই অশান্তির জের দিল্লী পর্যন্ত গড়ায়।চেষ্টা হয়েছিল,নির্বাচন এড়িয়ে দুই বিবদমান গোষ্ঠীকে নিয়ে মিলিঝুলি কমিটি করার। কিন্তু দুই পক্ষই নিজেদের অবস্থানে অনড় থাকে। একমাত্র সভাপতি পদ ছাড়া, অন্য প্রায় সবগুলি পদেই নির্বাচন হয়। নির্বাচনে এক গোষ্ঠীর ভরাডুবি ঘটে। এরপর থেকে ক্ষমতার লড়াই অন্যদিকে মোড় নেয়।নির্বাচিত নতুন কমিটি কাজ শুরু করে।এভাবে চলে বেশ কয়েক মাস। এরই মধ্যে এমবিবি কলেজ মাঠে দিন-রাতের খেলার জন্য অত্যাধুনিক ফ্লাড লাইট লাগানোর উদ্যোগ নেয় বর্তমান কমিটি।টেন্ডার দিয়ে সেই কাজ করানো হয়। ইতিমধ্যে কাজ প্রায় শেষের পথে বলে খবর। কিন্তু এই ফ্লাড লাইট বসানো নিয়ে বড় ধরনের আর্থিক দুর্নীতি হয়েছে বলে টিসিএর পরাজিত গোষ্ঠীর পক্ষ থেকে অভিযোগ উঠতে থাকে।এ নিয়ে কিছু ক্লাব প্রতিনিধি কয়েক দফা সভাপতি তপন লোধের কাছে ডেপুটেশনও দিয়েছে।যদিও এই অভিযোগ বরাবরই বর্তমান নির্বাচিত কমিটি অস্বীকার করে এসেছে।এ নিয়ে টিসিএতে ঠাণ্ডা লড়াই চলতে থাকে।এরপর বিরোধ চরমে উঠে গত ১৯ জুলাইয়ের পর থেকে। গত ১৯ জুলাই টিসিএর অ্যাপেক্স কমিটির সদস্যরা বৈঠক করে বর্তমান সভাপতি তপন লোধকে পদ থেকে বহিষ্কার করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। কারণ বর্তমান সভাপতি টিসিএর সংবিধান মোতাবেক সভাপতি পদে থাকার যোগ্যতা হারিয়েছেন। অর্থাৎ তিনি ‘ডিসকোয়ালিফাই’ হিসাবে বিবেচিত হয়েছেন। কেন তিনি ডিসকোয়ালিফাই হয়েছেন? কারণ তিনি আগরতলা পুর নিগমের কর্পোরেটর পদে রয়েছেন। কর্পোরেটর একটি লাভদায়ক পদ।টিসিএর সংবিধান মোতাবেক লাভদায়ক পদে থাকা কোনও ব্যক্তি টিসিএর পদে থাকতে পারবেন না। তাই তপন লোধকে টিসিএর সংবিধানের ১৪(৩)(ডি) ধারা মোতাবেক ডিসকোয়ালিফাই ঘোষণা করা হয়।১৯ জুলাই অনুষ্ঠিত বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন অ্যাপেক্স কমিটির মোট এগারোজন সদস্য। তারা হলেন টিসিএ সচিব তাপস ঘোষ, যুগ্ম সচিব জয়ন্ত দে, কোষাধ্যক্ষ জয়নাল দাস, সহসভাপতি তিমির চন্দ সহ অন্য সকল সদস্যরাই। বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন সহসভাপতি তিমির চন্দ। অ্যাপেক্স কমিটির এই সিদ্ধান্ত প্রকাশ্যে আসতেই বিরোধ চরমে উঠে।সেই বিরোধ একেবারে রাস্তায় নেমে আসে। টিসিএর পরাজিত গোষ্ঠী ফ্লাড লাইট দুর্নীতি নিয়ে সরব হয়ে উঠে। তারপরের ঘটনা শুধু রাজ্যবাসী নয়, প্রযুক্তির কল্যাণে দেশবাসীরও জানা হয়ে গেছে। গত ছয়দিন ধরে টিসিএ অচল হয়ে আছে। মামলা-পাল্টা মামলা হলেও পুলিশ এক পক্ষের নির্দেশে কাজ করছে বলে অভিযোগ উঠেছে। রবিবার রাতে টিসিএ সহ শহরের বিভিন্ন জায়গায় তিমির চন্দ থেকে শুরু করে আরও কয়েকজনের ছবি সহ ফ্লাড লাইট দুর্নীতির অভিযোগ এনে পোস্টারও লাগানো হয়েছে। সব থেকে মজার ঘটনা হল,গত ১৯ জুলাই টিসিএর অ্যাপেক্স কমিটির বৈঠকে উপস্থিত থেকে যুগ্ম সচিব জয়ন্ত দে গৃহীত সিদ্ধান্তে নিজেও স্বাক্ষর করেছেন।অথচ তিনি আবার ডিসকোয়ালিফাই সভাপতি তপন লোধের পক্ষে এক জোট হয়ে টিসিএ সচিব তাপস ঘোষ, সহসভাপতি জয়ন্ত দে এবং কোষাধ্যক্ষ জয়নাল দাসের বিরুদ্ধে থানায় মামলা দায়ের করেছে গতকাল অর্থাৎ রবিবার। পুলিশও একতরফা ভূমিকা নিয়ে কাজ করছে বলে অভিযোগ উঠেছে।পুলিশ এক পক্ষের অভিযোগ নিয়ে যতটা তৎপর, ততটাই নীরব অপর পক্ষের অভিযোগ নিয়ে। তিমির চন্দকে মারধর এবং পিস্তলকাণ্ডে তিনদিন পেরিয়ে গেলেও পুলিশ চুপ। স্বাভাবিকভাবেই এ নিয়ে গুঞ্জন চলছে।