সুলক্ষণ নয় গণতন্ত্রে।

 সুলক্ষণ নয় গণতন্ত্রে।
এই খবর শেয়ার করুন (Share this news)

সংসদে মণিপুর নিয়ে আলোচনায় কেন এখনও মৌন প্রধানমন্ত্রী, কেন তিনি একটি বারের জন্যও জাতি হিংসায় দীর্ণ মণিপুরে যাওয়ার প্রয়োজন বোধ করছেন না, দেশের প্রধান বিচারপতির উত্থিত আধ ডজন প্রশ্নেই এর উত্তর লুকিয়ে রয়েছে।সোমবার প্রধান বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড় সরল ভাষায় ব্যক্ত করেছেন যে, কেন দেশের অন্যান্য প্রান্তে মহিলাদের সঙ্গে ঘটে চলা হিংসার ঘটনাগুলি থেকে মণিপুর আলাদা। কী বলছেন মাননীয় প্রধান বিচারপতি ? বলেছেন, ‘এটা অস্বীকার করা যায় না যে, গোটা দেশেই মহিলাদের বিরুদ্ধে অপরাধ হচ্ছে। কিন্তু এখানে বিষয়টি আলাদা। মণিপুরে যা হয়েছে, আমরা এর পক্ষে যুক্তি দিতে গিয়ে অন্যান্য রাজ্যে এই হয়েছে, সেই হয়েছে বলতে পারি না। মণিপুরে মেয়েদের সঙ্গে যা ঘটেছে তা পরিকল্পিত, সামগ্রিক হিংসা।এই প্রেক্ষিতে মণিপুর নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারকে আধ ডজন প্রশ্ন করেছে সুপ্রিম কোর্ট। রাজ্যে দায়ের হওয়া ছয় হাজার এফআইআরের বিশদ ব্যাখ্যা চেয়েছে। মহিলাদের বিবস্ত্র করে প্রকাশ্যে ঘোরানোর পরে ওই ঘটনার এফআইআর করতে চৌদ্দ দিন লাগল কেন, কেন্দ্রের কাছে তা জানতে চেয়েছে শীর্ষ আদালত। এহ বাহ্য, মণিপুরের সঙ্গে কংগ্রেস শাসিত রাজস্থান-ছত্তিশগড় এবং তৃণমূলশাসিত পশ্চিমবঙ্গকে এক বন্ধনীতে ফেলার যে ‘হোয়াটঅ্যাবাউটরি’ কৌশল নিয়েছিল শাসক দল, সুপ্রিম কোর্ট তাকেই খারিজ করে দিয়ে বলেছে, মণিপুরে নির্যাতিতাদের পুলিশই উন্মত্ত ভিড়ের হাতে তুলে দিয়েছিল, তাই এই মামলার গুরুত্ব বাকিদের সঙ্গে এক বন্ধনীতে যায় না। নির্যাতিতাদের হয়ে সওয়ালে বিশিষ্ট আইনজীবী ইন্দিরা জয়সিং বলেন, তিন মাস ধরে মণিপুরে সাক্ষ্য-প্রমাণ লোপাট করে দেওয়া হচ্ছে। দুই মহিলাকে বিবস্ত্র করে ঘোরানোর ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীকে হত্যা করা হয়েছে।অতএব বোঝাই যাচ্ছে, এই ধরনের সুনির্দিষ্ট এবং তীক্ষ্ণ প্রশ্নের সম্মুখীন হতে চাইছেন বলেই মৌন রয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। অথচ সারা দেশের প্রায় দুই ডজন বিরোধী দল প্রধানমন্ত্রীর কাছে পদত্যাগের নয়, এমনকী মার্জনা ভিক্ষারও নয়, একটিই মাত্র ‘সামান্য’ দাবি জানিয়েছে। মণিপুরের ভয়াবহ ঘটনা এবং পরিস্থিতি নিয়ে সংসদে দাঁড়িয়ে একটি বিবৃতি দিন প্রধানমন্ত্রী। যে প্রধানমন্ত্রী কিছুদিন আগে আমেরিকার আইনসভায় ভারতীয় গণতন্ত্রের মহিমা প্রচার করে এসেছেন, সেই প্রধানমন্ত্রী বিরোধীদের দাবিতে সাগ্রহে সাড়া দিয়ে এমন একটি গুরুতর বিষয়ে সংসদীয় আলোচনার আয়োজন করবেন এবং সেই আলোচনায় নেতৃত্ব দেবেন-দুনিয়ার বৃহত্তম গণতন্ত্রে এটাই প্রত্যাশিত। প্রত্যাশিত কেন, বরং এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু নরেন্দ্র মোদির ভারতে স্বাভাবিকতার সংজ্ঞা স্বতন্ত্র। তীব্র সংকটকালীন পরিস্থিতিতেও তিনি কোনও মন্তব্য করেন না, কারও প্রশ্নের সদুত্তর দেন না, কেবলই নিজের পছন্দের ‘মন কি বাত’ প্রচার করেন। তাই প্রধানমন্ত্রীকে কথা বলানোর কৌশল হিসাবে বিরোধী দলগুলিকে সংসদে অনাস্থা প্রস্তাব আনার উদ্যোগ করতে হয়।প্রধানমন্ত্রী কথা বললেও আশ্বস্তও হওয়ার কোনও কারণ থাকবে কি না, সেই প্রশ্নও অযৌক্তিক নয়। মণিপুর নিয়ে সুদীর্ঘ ৭৮ দিনের মৌন পালনের পরে শেষ অবধি মুখ খোলেন বটে, তবে তিনি নিজের অমূল্য সময়ের ভান্ডার থেকে খরচ করেন মাত্র দুই মিনিট। তদুপরি ‘দুঃখে এবং রাগে’ মন ভরে রয়েছে ইত্যাকার সদুক্তি বিতরণেই সীমিত থাকেন। পরন্তু কৌশলে মণিপুরের সঙ্গে রাজস্থান বা ছত্তিশগড়ের মতো রাজ্যে নারী নির্যাতনের ঘটনাকেও জড়িয়ে দেন। নিজের অপরাধ বা দোষত্রুটির দায় এড়াতে অন্যের অপরাধ বা দোষত্রুটির দিকে আঙুল তোলার সেই অভ্যাসটি অধুনা ইংরেজি ভাষায় ‘হোয়াটঅ্যাবাউটরি’ নামে নিন্দিত। এই কৌশল তার পারিষদদের মুখে তবুও মানায়, প্রধানমন্ত্রীর মুখে মানায় না। মণিপুরের নারকীয় ঘটনাপ্রবাহের যেটুকু খণ্ডচিত্র প্রকাশ্যে এসেছে, তা যেকোনও সভ্য সমাজের কাছে চরম লজ্জার। অথচ মণিপুর প্রসঙ্গেও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নিজের আসনের গুরুত্ব বা সম্ভ্রম সম্পর্কে ন্যূনতম বোধ বিসর্জিত করে, অম্লানবদনে ‘তোমরাও করেছ, তার বেলা’? ধুয়ো তুলে যেভাবে কথা কথার মোড় ঘোরাতে চেয়েছেন, মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট চোখে আঙুল দিয়ে এবার সেটাই নির্দিষ্ট করে দিয়েছে। বারংবার শীর্ষ আদালতের এই উদ্বেগ কিন্তু গণতন্ত্রের পক্ষে মোটেও সুলক্ষণ নয়।

Dainik Digital

Dainik Digital

Leave a Reply

Your email address will not be published.