মুখ্যমন্ত্রী যা বলেছেন

 মুখ্যমন্ত্রী যা বলেছেন
এই খবর শেয়ার করুন (Share this news)

গত সোমবার ‘বিভাজন বিভীষিকা স্মৃতি দিবস’ অনুষ্ঠানে রবীন্দ্র শতবার্ষিকী ভবনে মুখন্ত্রী ডা. মানিক সাহা বলেছেন, ১৯৪৭ সালে শুধুমাত্র ‘দুই ব্যক্তির’ অভিপ্রায় চরিতার্থ করতে ভারত ভাগ হয়েছিল। একই সঙ্গে তার বক্তব্য ছিল, ‘আমরা যদি মনে করি শুধুমাত্র হিন্দুরাই দেশভাগ চাননি, তাহলে ভুল হবে। অনেক মুসলিম নেতা শিখ এবং অন্যান্য ধর্মে বিশ্বাসী লোকেরাও দেশভাগের বিরোধিতা করেছিলেন।… দেশভাগের জন্য দায়ী ছিলেন দুইজন। উদ্দিষ্ট দুই ব্যক্তি’র নাম মুখ্যমন্ত্রী উল্লেখ না করলেও তিনি যে জিন্না ও নেহরুকে বোঝাতে চেয়েছেন, সেটি বুঝতে অসুবিধা হয়নি।গত বছর থেকে ১৪ আগষ্টকে ‘দেশভাগ স্মৃতি দিবস’ বা বিভাজন বিভীষিকা স্মৃতি দিবস বলে ঘোষণা করা হয়েছে। সে দিক দিয়ে দেখলে এবার ছিল সেই ‘পার্টিশন রিমেমব্রান্স ডে’র দ্বিতীয়বর্ষ। দেশভাগের স্মৃতি নি:সন্দেহে জাগরূক রাখা দরকার। পরবর্তী প্রজন্মকে মনে করিয়ে দেওয়া জরুরি, কত রক্তক্ষয় ও সর্বনাশের মূল্যে এই দেশ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের কাছ থেকে তার স্বাধীনতা কিনতে পেরেছিল। কিন্তু সেই দেশভাগের স্মৃতি মনে করাতে গিয়ে কেউ যদি কেবলই কোনও একটি বিশেষ পক্ষের উপর অন্য পক্ষের অত্যাচার প্রমাণে উদগ্র হয়ে উঠেন, তাহলে সেই রাজনীতি বিষবৎ পরিত্যাজ্য। ধন্যবাদার্হ্য মুখ্যমন্ত্রী, তিনি সে পথে না হেঁটে সত্য উচ্চারণে বলেছেন মুসলিম, শিখ এবং অন্যান্য ধর্মে বিশ্বাসী বহু মানুষ দেশভাগের বিরোধিতা করেছিলেন।দেশভাগ অনিবার্য ছিল কি ছিল না না, তা নিয়ে গত ছিয়াত্তর বছর ধরে বহু চর্চা হয়েছে এবং হয়ে চলেছে। অধিকাংশ চর্চার নির্যাস, সে সময় দেশভাগ না করে কোনও গত্যন্তর ছিল না।

May be an image of 11 people and dais


তবে সেটিও অর্ধসত্য। কারণ ইতিহাস এক বহমান স্রোত। সে স্রোত বিরতিহীন, নিরন্তর প্রবহমান। ইতিহাসে শেষ কথা কেউ বলে না। বরং দিন থেকে দিনান্তে ইতিহাসের দৃষ্টিভঙ্গিও পাল্টে যায়। একই বিষয়কে অন্য দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখার প্রবণতা বাড়ে। ভারতের স্বাধীনতা অথবা দেশভাগ, যেভাবেই দেখা যাক না কেন, এটি একটি আদ্যন্ত জটিল, বৃহৎ এবং ধর্মীয় ভাবাবেগ সম্পৃক্ত বিষয়, যা নিয়ে একেবারে বস্তুনিষ্ঠ কোনও তত্ত্ব বা তথ্যে উপনীত হওয়া সম্ভব নয়।রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ, হিন্দু মহাসভার নেতৃত্ব প্রথমদিন থেকে দেশভাগের অনিবার্যতার তত্ত্ব মানেননি, আজও মানেন না। তারা যে অখণ্ড ভারতের স্বপ্ন দেখেন, তার পিছনে কাজ করে একটি নির্দিষ্ট মনস্তত্ত্ব। সেটি হল, জওহরলাল নেহরু আমাদের দেশটাকে দ্বিখণ্ডিত করার জন্য দায়ী, কংগ্রেসে সে সময় নেহরুর পাল্টা সমান্তরাল কোনও শক্তিশালী নেতৃত্ব থাকলে দেশটা কখনোই ভাগ হতো না। বস্তুত এটিও একটি চরমপন্থী অবস্থান, ঠিক যেমন দেশভাগের অনিবার্যতার তত্ত্বে যারা বিশ্বাস করেন তাদের অবস্থানও চরমপন্থী। ১৯৪৭ সালের ১৫ আগষ্ট আরএসএসের মুখপত্র ‘অর্গানাইজার’ (যা এখনও নিয়মিত প্রকাশিত)-এর প্রথম পৃষ্ঠায়ে খণ্ডিত ভারতের মানচিত্র মাতৃমূর্তির অবয়বে প্রকাশিত হয়েছিল। সেই মানচিত্রে দেখানো হয়েছিল, ভারতমাতার একটি হাত তার দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছে এবং সেই বিচ্যুত হাতটির পাশে ছুরি হাতে দণ্ডায়মান নেহরু। বাকি কুশীলবদের ছেড়ে এত বড় একটি ঘটনার পিছনে ‘কেষ্ট বেটাই চোর’ তত্ত্ব খাড়া করে এককভাবে শুধু নেহরুকে দায়ী করলে ইতিহাসের অপলাপ হবে। এই দায়ী করার পিছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের প্রয়াস থাকলেও থাকতে পারে এবং আছেও।রাশিয়ার জোসেফ স্তালিনের মৃত্যুর পরে নিকিতা ক্রুশ্চেভ যেভাবে ‘ডি-স্ট্যালিনাইজেশন’ অর্থাৎ স্তালিনবাদের প্রভাব ও স্মৃতিকে নির্মূল করার নীতি গ্রহণ করেছিলেন এবং সেই সূত্রে স্তালিনের নামাঙ্কিত স্মৃতিস্তম্ভ, স্মারক রাস্তা ইত্যাদির নাম পাল্টে দেওয়ার পথে হেঁটেছিলেন, গত দশ বছর ধরে ভারতবর্ষেও তেমনই ‘ডি- নেহরুআইজেশন’ প্রক্রিয়াটি সাড়ম্বরে চলছে। অবশ্যই ঘোষিত আকারে চলছে না, তবে অঘোষিতভাবে এমন সব ঘটনা ঘটে চলেছে যাতে ইতিহাসের পাতা থেকে না হলেও (সম্ভব নয়) অন্তত নেহরু ভারতীয় ইতিহাসে যে রাজসিংহাসনে অধিষ্ঠান করছেন, সেখান থেকে তাকে বিচ্যুত করা সম্ভব নয়। দেশভাগ নিয়ে তাই কোনও নির্দিষ্ট বক্তব্যে উপনীত হওয়া কারও পক্ষেই সম্ভব বলে মনে হয় না।

May be an image of 9 people
Dainik Digital

Dainik Digital

Leave a Reply

Your email address will not be published.