বিনীত প্রশ্নমালা।
লালকেল্লায় পতাকা উত্তোলন করে স্বাধীনতা দিবসে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আগামী বছর লড়াইয়ে মন্ত্র ঘোষণা করেছেন। তা হল, দুর্নীতি, পরিবারতন্ত্র ও তোষণের বিরুদ্ধে লড়াই।তার বিরুদ্ধে এককাট্টা হওয়া কংগ্রেস ও আঞ্চলিক দলগুলির ইন্ডিয়া’ জোটের শরিকদের পরিবারবাদী দল হিসেবে দাগিয়ে দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, দুর্নীতি, পরিবারতন্ত্র ও তোষণ— এই তিনের বিরুদ্ধে সর্বশক্তি দিয়ে লড়তে হবে, কারণ এরাই উন্নয়নের সবচেয়ে বড় শত্রু।দুর্নীতি ও তোষণের বিষয়টি আপাতত থাক,বরং পরিবারতন্ত্রের শিকড় নির্মূল করতে গত দশ বছরে কেন্দ্রের সরকার কী ভূমিকা নিয়েছে, তা নিয়ে সবিনয়ে কিছু প্রশ্ন তোলা যায়। ‘আপ’ বাদে বাকি বিরোধী দলগুলি পরিবারতন্ত্রে আকীর্ণ, সে নিয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু বিজেপির ভিতরে পৌরপিতা থেকে শুরু করে বিধায়ক, সাংসদ থেকে মন্ত্রীর মধ্যে কতজন সাধারণ কার্যকর্তা থেকে উঠে আসা এবং কতজন পরিবারতন্ত্রের ফসল, তা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিরোধীরাও শ্বেতপত্র দাবি করতে পারে।প্রধানমন্ত্রীর মন্ত্রিসভা থেকেই শুরু করা যাক। কেন্দ্রীয় ক্রীড়া ও তথ্য- সম্প্রচার মন্ত্রী অনুরাগ ঠাকুর হিমাচল প্রদেশের দুইবারের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী প্রেমকুমার ধুমলের পুত্র। প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংয়ের পুত্র পঙ্কজ সিং উত্তরপ্রদেশ বিজেপির সহ-সভাপতি এবং নয়ডার মতো সমৃদ্ধ কেন্দ্রের বিধায়ক। শিল্প ও বাণিজ্য, ক্রেতা সুরক্ষা, খাদ্য ও গণবন্টন এবং বস্ত্রমন্ত্রী পীযূষ গোয়েলের পিতৃদের বেদপ্রকাশ গোয়েল ছিলেন বাজপেয়ী মন্ত্রিসভায় জাহাজমন্ত্রী। তার মা চন্দ্রকান্ত গোয়েল ছিলেন মহারাষ্ট্রের মাতুঙ্গা কেন্দ্রের তিনবারের বিজেপি বিধায়ক। কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী ধর্মেন্দ্র প্রধানের পিতা দেবেন্দ্র প্রধান ছিলেন বাজপেয়ী মন্ত্রিসভায় পরিবহণ এবং কৃষিমন্ত্রকের রাষ্ট্রমন্ত্রী। পৃথ্বীবিজ্ঞান মন্ত্রী কিরেন রিজিজুর পিতা রিংচিন খারু ছিলেন অরুণাচল প্রদেশের প্রথম প্রোটেম স্পিকার। বিমানমন্ত্রী জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়ার পিতা মাধবরাও সিন্ধিয়াও ছিলেন প্রাক্তন বিমানমন্ত্রী। সর্বোপরি সিন্ধিয়ারা গোয়ালিওয়ের রাজপরিবার। এই পরিবারের কন্যা বসুন্ধরা রাজে সিন্ধিয়া পরিবারতন্ত্রের বিরুদ্ধে কথা বলেন বটে, তবে কদাপি নিজের সাংসদপুত্র দুষ্যস্ত সিংয়ের ব্যাপারে রা কাড়েন না। বিজেপির রাষ্ট্রীয় মহাসচিব তথা ছয়বার ইন্দোরের বিধায়ক কৈলাস বিজয়বর্গীয়র পুত্র আকাশও বিধায়ক। দিন কয়েক আগে ‘পরিবারবাদ কুইট ইন্ডিয়া’ প্ল্যাকার্ড হাতে সংসদ ভবনের সামনে গান্ধীমূর্তির পাদদেশে যে নীরজ শেখরকে দেখা গেছিল, তিনি অন্য কেউ নন, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী চন্দ্রশেখরের পুত্র। গোপীনাথ মুণ্ডের কন্যা পঙ্কজা মুণ্ডে বিজেপির রাষ্ট্রীয় সচিব। বিহারের বিজেপি সাংসদ সঞ্জয় জয়সওয়ালের পিতা মদনপ্রসাদ জয়সওয়াল ওই একই কেন্দ্রের বিজেপি সাংসদ ছিলেন। বিহারের পশ্চিম চম্পারন জেলায় গত তিরিশ বছর ধরে শেষ কথা বলে এই জয়সওয়াল পরিবার। মধুবনির সাংসদ অশোক যাদবের স্বনামধন্য পিতা হুকুমদেব নারায়ণ যাদব দীর্ঘ বছর ওই কেন্দ্রেই সাংসদ ছিলেন। হাজারিবাগের সাংসদ জয়ন্ত সিন্হা প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী যশবন্ত সিন্হার পুত্র। পশ্চিমবঙ্গের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী কী ? তিনিও আদ্যন্ত পরিবারতন্ত্রেরই প্রতিভূ।বিজেপির ক্রোড়ে বসে মহারাষ্ট্রে যিনি মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন সেই একনাথ শিন্ধে, নিজ দলের তিনিই নেতা, তিনিই মুখ্যমন্ত্রী। তদুপরি তার তরুণ পুত্র শ্রীকান্ত শিন্ধে সাংসদ। বিহারে লালুর সঙ্গ ছেড়ে রামবিলাস পাসোয়ানের যে পার্টি আজ বিজেপির পাশে, সেই এলজেপি শুধুমাত্র পাসোয়ান পরিবারভিত্তিক দল।এই তন্ত্রের আরও এক প্রতীক উত্তরপ্রদেশের আপনা দলের প্রতিষ্ঠাতা সোনেলাল প্যাটেলের কন্যা তথা কেন্দ্রীয় শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রকের রাষ্ট্রমন্ত্রী অনুপ্রিয়া প্যাটেল। সম্প্রতি বিজেপিতে শামিল সঞ্জয় -রাজভড়ের ‘নিষাদ’ পার্টি কোন্ তন্ত্রের ফসল ? মহারাষ্ট্রে অজিত পাওয়ার, নারায়ণ রাণেও, প্রধানমন্ত্রী কথিত পরিবারবাদেরই ফসল।এক্ষণে বিনীত প্রশ্ন, এরা সকলে যখন পরিবারতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ শোনেন তখন তাদের ভিতরে কেমন অনুভূতি হয় ? এহ বাহ্য, আগামী নির্বাচনে এরা যখন জনসভায় দাঁড়িয়ে পরিবারতন্ত্রের মুণ্ডপাত করে বক্তৃতা দেবেন, তখন তারা কি নিজেদের গর্বিত বোধ করবেন, না কি লজ্জিত ?ঘুরিয়ে তির মারা রাজনীতির বহু প্রাচীন একটি কৌশল। আমজনতা দৈনন্দিন যে সমস্যাসঙ্কুল স্রোতের বিরুদ্ধে সাঁতার কাটছে, নেতা সে কথা কৌশলে এড়িয়ে বারংবার বলতে থাকেন যে, কোন বিপরীত স্রোত তাকে উৎপীড়নের মধ্যে রেখেছে। কিন্তু বিষবৃক্ষের ফল যদি নিজ বাগানেই শোভা পায়, তখন কি তা শ্রীফলে রূপান্তরিত হয় ?