তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি
লালকেল্লা থেকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দাবি করছেন, তিনি ২০২৪-র লোকসভা ভোটে জিতে আসবেন এবং তার তৃতীয় দফার প্রধানমন্ত্রিত্বে ভারত বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি হয়ে উঠবে।এমন কথা শুনে দেশের আমজনতার বুক গর্বে ফুলে উঠবে, সেটাই স্বাভাবিক। আবার সমালোচকেরা প্রধানমন্ত্রীর এই দাবিকে ‘রাজনৈতিক জুমলা’ তথা অনৃত ভাষণও ভাবতে পারেন।গত জুন মাসে আমেরিকার কংগ্রেসে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী সগর্বে বলেছিলেন, ২০১৪-য় তিনি যখন ক্ষমতায় এলেন, ভারত তখন বিশ্বের দশম বৃহত্তম অর্থনীতি।তার দ্বিতীয় দফার প্রধানমন্ত্রিত্বে ভারত বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতি হয়ে উঠেছে।তৃতীয় দফায় তা পৌঁছে যাবে তৃতীয় স্থানে।প্রধানমন্ত্রীর ভবিষ্যদ্বাণী কি সত্যিই মিলে যাবে, আর বছর পাঁচেকের মধ্যে ভারত বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ হয়ে উঠবে? বস্তুত, প্রধানমন্ত্রীর আগেই ভারতের অর্থনীতি সম্পর্কে এমন পূর্বাভাস দিয়েছে আন্তর্জাতিক মূল্যায়নকারী সংস্থা স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড পুত্তর এবং মর্গান স্ট্যানলি। একই কথা বলেছে আন্তর্জাতিক অর্থ ভান্ডার (আইএমএফ)। ভারত এখন জনসংখ্যার বিচারে বিশ্বে এক নম্বরে।১৪০ কোটি মানুষের উন্নয়নশীল দেশের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বা জিডিপি- ও যে বেশি হবে, সেটাই স্বাভাবিক। সেই জিডিপির নিরিখে ভারত ইতিমধ্যে ব্রিটেনকে টপকে বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতি হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছে। সামনে এখন চারটি দেশ আমেরিকা, চিন, জার্মানি ও জাপান। প্রধানমন্ত্রী দাবি করেছেন, ২০২৯-র লোকসভা নির্বাচনের আগেই ভারত জার্মানি ও জাপানকে পিছনে ফেলে তৃতীয় স্থানে পৌঁছে যাবে। অর্থনীতির পণ্ডিতদের একাংশ বলছেন, জিডিপির বিচারে ২০২৭ সালেই ভারত তৃতীয় স্থানে উঠে আসবে। এদের যুক্তি হল, ভারতের জিডিপি এখন ৩.৭ লক্ষ কোটি ডলার। জাপান ও জার্মান দুই দেশেরই জিডিপি ৪.৩ লক্ষ কোটি ডলার। সংশ্লিষ্ট দুই দেশই যথেষ্ট উন্নত, সমৃদ্ধ অর্থব্যবস্থা। তাই তাদের আর্থিক বৃদ্ধির হার অনেক কম। করোনা-উত্তর পরিস্থিতিতে ভারতের আর্থিক বৃদ্ধি আট বা নয় শতাংশের বদলে এখন ছয় থেকে সাত শতাংশ হলেই সরকার খুশি। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলির হিসাবে, নোটবন্দি কিংবা কোভিডের মতো দুর্যোগ না এলে, পাটিগণিতের নিয়মেই ভারত জার্মানি ও জাপানকে পেছনে ফেলে দেবে।এ তথ্য নির্ভেজাল সত্য যে, মোদির জমানাতেই ভারত বিশ্বের দশম বৃহত্তম অর্থনীতি থেকে পঞ্চম স্থানে উঠে এসেছে। ব্রাজিল, ইটালি, ফ্রান্স, ব্রিটেনের মতো দেশকে ভারত পেছনে ফেলে দিয়েছে।তবে এখানে একটি ধোঁয়াশামিশ্রিত প্রশ্ন আছে। যাদের পেছনে ফেলে ভারত আজ পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ, তাদের চেয়ে কি আমরা অনেক উন্নত রাষ্ট্র? এমনকী, আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে ভারতের অর্থনীতি জাপান এবং জার্মানিকে টপকে গেলে ভারত কি উন্নত বা বিকশিত রাষ্ট্রের তকমা পাবে, তাদের চেয়ে সমৃদ্ধ রাষ্ট্র হয়ে উঠবে? তা কিন্তু একেবারেই নয়। মাথাপিছু আয় না বাড়লে দেশের সমৃদ্ধি আসে না। আয় বেশি হলেও লোকসংখ্যা অনেক বেশি হওয়ায় ভারতের মাথাপিছু আয় খুবই কম। জার্মানি, জাপান বা ব্রিটেনের মাথাপিছু আয় আমাদের তুলনায় ঢের বেশি। ধরা-ছোঁয়ার বাইরে।ভারতের মাথাপিছু জিডিপি এখন ২২০০ ডলারের সামান্য বেশি। সেখানে ব্রিটেনের মাথাপিছু জিডিপি ৪৭,৩৭৪ ডলার। জিডিপির নিরিখে ভারত বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতি হলেও মাথাপিছু আয়ে ভারত ১৮৯টি দেশের মধ্যে ১৪১তম স্থানে। প্রায় পেছনের সারিতে। তবে এতেও ভুল নেই যে, মোদি জমানায় দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় বেড়েছে। ২০১৪-১৫ সালে মাথাপিছু আয় যেখানে ছিল বছরে প্রায় ৮৬ হাজার টাকা, ২০২২-২৩ সালে তা প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। বছরে প্রায় ১ লক্ষ ৭২ হাজার টাকা। অর্থাৎ, মাসে ১৪,০০০ টাকার মতো। উন্নত রাষ্ট্রের আবশ্যিক শর্ত হচ্ছে, আর্থিক বৈষম্য দূরীকরণ। আয়ের মাপকাঠিতে উপরের সারিতে থাকা জনসংখ্যার ১ শতাংশ ধনকুবেররা এখন ভারতের ৪০ শতাংশের বেশি সম্পদের মালিক। দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় বাড়লে, আয়বৃদ্ধির বৈষম্য কমলে, দেশ সমৃদ্ধ হলে তবেই তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির সার্থকতা। না হলে তা কেবলই ভোট বৈতরণী পারানির উপাচার।