গণতন্ত্রের জননী

 গণতন্ত্রের জননী
এই খবর শেয়ার করুন (Share this news)

জি -২০ আন্তর্জাতিক যজ্ঞ সমাপনের পর মাত্র এক মাসের বিরতি।ঠিক মহালয়ার পূর্বাহ্নে, ১২-১৪ অক্টোবর দেশের নবনির্মিত সংসদ ভবনে বসবে আরও একটি মহাসম্মেলনের আসর। যার পোশাকি নাম ‘স্পিকার্স অব পার্লামেন্টস অব জি ২০ কান্ট্রিজ’, সংক্ষেপে পি ২০’। জি ২০-র মতোই পি২০- মূল রাগ ‘ভারত গণতন্ত্রের জননী’।

May be an image of 11 people and temple


প্রাচীন ভারত গণতন্ত্রের জননী, মনে করেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।এ কথা তিনি রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ সভায় বলেছেন। আমেরিকায় কংগ্রেসের যুগ্ম অধিবেশনে তার পুনরাবৃত্তি করেছেন। প্রশ্ন হলো, ভারত কি প্রকৃতই গণতন্ত্রের জননী ? মহাভারতের শান্তির পূর্বে কেবল রাজধর্মেরই জয়গান শুনি। এর বেশ কিছু কাল পরে লেখা মনু স্মৃতিতে গণতন্ত্রের কথা নেই। মন্ত্রদ্রষ্টা মহীদশার মন্ত্রজাত ‘ঐতীরে ব্রাহ্মণ- এর গল্প বলে যে, দেবতারা একবার অসুরদের কাছে যুদ্ধে পরাজিত হলেন। অনুসন্ধান করে দেখা গেল এই পরাজয়ের কারণ, দেবতাদের কোনও রাজা নেই। তখন দেবতারা মিলে মহাপরাক্রমশালী ইন্দ্রদেবকে রাজা মনোনীত করলেন। অর্থাৎ এ গল্পে গণতন্ত্র নয়, রাজার মাহাত্ম্য স্পষ্ট। কূটতর্কে কেউ বলতেই পারেন, এই রাজা হবেন নির্বাচিত। তা ঠিক নয় কারণ স্বর্গে কারও মৃত্যু হয় না। ফলে উত্তরাধিকারের প্রশ্ন উঠে না।

May be an image of 2 people, dais and text that says "G26 भारत INH व EARTH ON"


সিন্ধু উপত্যকার অথবা সিন্ধু-সরস্বতী উপত্যকার সভ্যতাই ভারতে সর্বপ্রাচীন বলে গণ্য করা হয়। মহেঞ্জোদারো এবং হরপ্পা এই সভ্যতার দুই উজ্জ্বল নিদর্শন। অনুমান, খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ সাল পর্যন্ত ছিল এই সভ্যতার সময়কাল। সেখানেও গণতন্ত্রের উল্লেখ নেই। এর পরে আসে বৈদিক যুগ। ঋগ্বেদ এবং অন্য তিনটি বেদ রচিত হয়। এই যুগে প্রতিষ্ঠিত হয় ছোট-বড় রাজার রাজত্ব। রাজা চান ছোট থেকে বড় হতে। ব্রাহ্মণ বলেন, সে জন্য যজ্ঞের প্রয়োজন। অতএব চালু হয় অশ্বমেধ ইত্যাদি যজ্ঞ। বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ যজ্ঞের বেদির আয়তন হিসেবে কযে ঠিক করে দেন। প্রজাদের সেখানে কোনও ভূমিকা নেই। অতঃপর খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে ঘটে যায় দুইটি বড় পরিবর্তন। ভগবান মহাবীর এবং গৌতম বুদ্ধের আবির্ভাব। একদিকে দুই ধর্মের প্রচার, অন্যদিকে নগরায়ন। শুরু হয় বাণিজ্যের প্রসার। সঙ্ঘাশ্রম ধর্মের প্রভাব, সেই প্রথম নগরগুলির পরিচালন ব্যবস্থা আসে নির্বাচিত প্রতিনিধির হাতে। কিন্তু দেশের সিংহভাগ ক্ষমতা কুক্ষিগত থাকে ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয়ের অংশীদারিত্বে। বাকিটা ব্যবসায়ীদের দখলে। খ্রিস্টপূর্বে চতুর্থ শতকে অ্যালেকজাণ্ডার ভারত জয় করতে এসে ব্যর্থ হয়ে ফিরে যান। এর অব্যবহিত পরে সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য সাম্রাজ্যের পত্তন করেন। সম্রাট অশোক ছিলেন তার পৌত্র। এই যুগাবসানের পরে আসে গুপ্তযুগ। গুপ্তযুগকে বলা হয় হিন্দুদের স্বর্ণযুগ। এই যুগ শেষ হতেই দেশ চলে যায় ইসলামধর্মী লুটেরাদের হাতে। তারপর আসে ইংরেজ শাসন। মৌর্য যুগ থেকে ইংরেজ যুগ, শাসন ক্ষমতার গুরুভার সামলেছেন যে আমলারা তারা গণতন্ত্রে পুজারি নন।

May be an image of 2 people, dais and text


অশ্রুজলে নেহরু যুগকে বিদায় জানিয়ে এখন মোদি যুগ। নতুন ভারত গড়ার যুগ। ব্রিটিশ এবং ইসলাম জমানার ধারক সমস্ত সৌধ, স্মারক, রাস্তাঘাট, পুরনো আইন ইত্যাদি বাহ্য, এমনকী ধর্মনিরপেক্ষ পরিসরগুলিতে হিন্দু প্রতীক এবং ভাবধারার প্রবেশের মাত্রা বাড়িয়ে এ যুগ স্পষ্ট করে দিতে চাইছে উত্তর-ঔপনিবেশিক ভারতের থেকে ভাষা ও ভাবগত ক্ষেত্রে পৃথক হওয়াই তার বাসনা। কিন্তু মুশকিল হলো, সাংস্কৃতিক শিকড়ের ধুয়া তুলে রাজনৈতিক ব্যবস্থাগুলি প্রায় দ্রষ্টার দৃষ্টি ভঙ্গির নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। এই জায়গা থেকেই তামিলনাড়ুর রাজনীতিবিদরা ‘সনাতন ধর্ম’র পরম্পরাগত স্তর বিভাজনকে আক্রমণ করেন। একই প্রেক্ষাপটে চিন আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে কনফুসিয়াস বর্ণিত স্তর বিভাজনের মধ্যে থেকে উঠে আসা সম্প্রীতিকে দেখতে চায়।’নতুন ভারত’ ধর্মনিরপেক্ষ-যুক্তিবাদী মূল্যবোধের বিষয়টি থেকে বেরিয়ে গিয়ে বিপরীতের ‘সারভাইভাল ভ্যালু’ অর্থাৎ শিকড়ের সংস্কৃতির অভিমুখে চালিত মূল্যবোধের দিকে ঢলে পড়ছে। সামাজিক সহিষ্ণুতা, জনমতের বহিঃপ্রকাশের মতো সেল্‌ফ এক্সপ্রেশন ভ্যালু’র চেয়ে যা চরিত্রগতভাবে আলাদা। মোদি সরকারের সাংস্কৃতিক ধাক্কা বস্তুত তাদের একত্র করতে চাইছে, যারা স্বঘোষিত ‘এলিট’ বা অভিজাত নন। ঘটনা হলো ভারত এমনই একটি দেশ, যা কোনওদিনই বৈপরীত্য থেকে মুক্তি পাবে না। তথাপি মোদির মতো বলিষ্ঠ নেতা এখন ভারতকে ‘গণতন্ত্রের জননী’ বলে অভিহিত করেছেন, তখন সব ঠিক হ্যায়’ বলা ছাড়া গত্যন্তর আছে কি?

May be an image of 2 people and text
Dainik Digital

Dainik Digital

Leave a Reply

Your email address will not be published.