পুনর্বিন্যাসের নেপথ্যে!!

 পুনর্বিন্যাসের নেপথ্যে!!
এই খবর শেয়ার করুন (Share this news)

অমৃতকালে সেঙ্গল-শোভিত নতুন সংসদ ভবনের প্রথম বিশেষ অঅধিবেশনেই এক যুগান্তকারী ঘটনার সাক্ষী হয়েছে এ দেশ।দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর সংসদে পাস হয়েছে মহিলা সংরক্ষণ বিল- নারীশক্তি বন্দন অধিনিয়ম’। নামটি শুনতেও অনেকটা দৈববাণীর মতো।বিল পাসের পর প্রধানমন্ত্রী বলেই দিয়েছেন যে, এই সব ভাল কাজ সম্পন্ন করার জন্যই ভগবান তাকে দায়িত্ব দিয়ে পাঠিয়েছেন।প্রশ্ন হল,দীর্ঘ -প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে বিল পাসের পরেও তাকে বাস্তবায়িত করতে আবার দীর্ঘ প্রতীক্ষা কেন?

আমরা সকলেই জানি, যেকোনও জনগণনাতেই দেখা যাবে নারীর সংখ্যা মোট জনসংখ্যার অর্ধেক।আর তেত্রিশ শতাংশ সংরক্ষণের অর্থ মোট আসনসংখ্যা যাই হোক না কেন, তার এক-তৃতীয়াংশ আসন মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত থাকবে।তা হলে আগামী নির্বাচনেই এই নীতি প্রয়োগ করার পরিবর্তে পরবর্তী জনগণনা ও আরও জটিল ও সময়সাপেক্ষ ডিলিমিটেশন প্রক্রিয়ার জন্য অপেক্ষা করা কেন?ডিলিমিটেশন,যার অর্থ জনসংখ্যার ভিত্তিতে লোকসভার রাজ্যভিত্তিক
আসনের পুনর্বিন্যাস।সন্দেহ নেই এই আসন্ন ঘটনা ভারতীয় গণতন্ত্রকে, যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে আমূল পাল্টে দিতে চলেছে।এই আসন্ন ঘটনাটি নিয়ে উত্তর ভারত, আরও নির্দিষ্ট করে বললে, উত্তর ও মধ্য ভারতের হিন্দিবলয় বলে খ্যাত যে অঞ্চল,তাদের জন্য যতখানি সুখবর, দেশের বাকি অংশের জন্য ততটাই সংকটের পদধ্বনি।আসন পুনর্বিন্যাসের হৃষ্টতার বাতাস যতই জোরদার হচ্ছে, দক্ষিণ ভারত ততটাই বিপন্ন বোধ করছে।

শুধু দক্ষিণ ভারত কেন, বিশেষত দেশের সেই সব অংশ যারা সাক্ষরতা, শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে আগুয়ান তারাও বিপন্ন বোধ করছে। কারণ, নতুন জনগণনার নিরিখে আসন পুনর্বিন্যাসের সূত্রে লোকসভা ও বিধানসভায় আসন বাড়তে চলেছে। এই পুনর্বিন্যাসের অবধারিত ফলাফল হবে, যে রাজ্যে জনসংখ্যা যত বেশি সেখানে লোকসভার আসনসংখ্যা তত বেশি। অপরদিকে, যে প্রদেশে জনসংখ্যা কম কিংবা গত দশ বছরে সেই সংখ্যায় উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি ঘটেনি সেখানে আসন সংখ্যা বাড়বে কম, হয়তোবা অপরিবর্তিতই থাকবে। সুতরাং বেশি আবাদির রাজ্যগুলির ক্ষমতা কম আবাদির রাজ্যগুলিকে ছাপিয়ে যাবে। তখন আইন পাসের ক্ষেত্রেই হোক কিংবা যে কোনও সংসদীয় কার্যক্রমেই উত্তর ভারত যা চাইবে, দক্ষিণ পূর্ব ও পূর্বোত্তর ভারতকে নীরবে তাকে সমর্থন করে যেতে হবে।কেননা প্রতিবাদের সংখ্যাই তারা হারিয়ে ফেলবে।উত্তর ভারতের চেয়ে দক্ষিণ ভারত অধিক উন্নয়নশীল এবং সেই উন্নয়নের অন্যতম সূচক জনসংখ্যার হারে লাগাম পরানো। কিন্তু এমন সাফল্য অর্জনের জন্য তারা পুরস্কৃত হওয়ার বদলে, আসন পুনর্বিন্যাসের পরে সংসদে তাদের ‘ছোট’ হতে হবে।এমনটা ঘটলে তাকে কখনোই ন্যায় বলা যায় না। স্বাধীনতা, সাম্য ও বন্ধুত্বের উপর দাঁড়িয়ে আছে আমাদের সংবিধান তথা গণতন্ত্র। নিজেকে যুক্তরাষ্ট্রীর বলে একদা যে গণতন্ত্রের যাত্রা শুরু হয়েছিল, এমনটা ঘটে গেলে তা হবে কার্যত আত্মঘাতের শামিল। স্বাভাবিকভাবেই দক্ষিণ ভারতীয় রাজনীতি তাই এ নিয়ে উদ্বিগ্ন, বিচলিত এবং ভীত। বস্তুত, এই উদ্বেগ থেকেই এমজিআর প্রতিষ্ঠিত জয়ললিতার দল’ এআইএডিএমকে বিজেপির সঙ্গে মাঝরাস্তায় সম্পর্ক ছিন্ন করে আনুষ্ঠানিকভাবে এনডিএ জোট ছেড়ে বেরিয়ে আসার কথা ঘোষণা করেছে। তামিলনাড়ুতে ভারতীয় জনতা পার্টি এখন কার্যত একাকী।শুধু দক্ষিণ ভারতই নয়, বিন্ধ্যপর্বতের উত্তরদিকে যেসব প্রদেশ উত্তর ভারতের জনবহুল গোবলয়ের অন্তর্গত নয়, যেমন পশ্চিমবঙ্গ এবং ওড়িশা, তারাও আসন্ন পুনর্বিন্যাসের শঙ্কায় শঙ্কিত। একই শঙ্কা পূর্বোত্তরের একাধিক রাজ্যে, যারা জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে সাফল্য দেখিয়েছে। বিপদ তাদেরও। কেননা ডিলিমিটেশনের ফলে কেবল উত্তর-দক্ষিণের ভেদই বাড়বে না, রাজনীতি মানচিত্রেও খুব বড় একটি পরিবর্তন আসার সম্ভাবনা প্রবল। হিন্দুত্ববলয় বলে উত্তরের যে অঞ্চল খ্যাত, সেখানে যে রাজনীতি জনপ্রিয়, তা দেশের অন্যান্য আঞ্চলের রাজনীতিকে অনেকাংশে গ্রাস করবেই।জনগণনার সূত্রে আসনে পুনর্নির্ধারণ ঘটলেও গত পঞ্চাশ বছরে লোকসভা ও বিধানসভার আসনের মোট সংখ্যার কোনও হেরফের হয়নি।পঞ্চাশ বছর পর এই বার আসনসংখ্যাই বাড়তে চলেছে। এর ফলে কেবল যুক্তরাষ্ট্রীয়তার বিপদই ঘটবে না, গণতান্ত্রিক রাজনীতির চেহারাও অনেকখানি পাল্টে যাবে।

Dainik Digital

Dainik Digital

Leave a Reply

Your email address will not be published.