অসহনীয়!!
শিয়রে কড়া নাড়ছে পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচন।সম্প্রতি মধ্যপ্রদেশের রাজগড় বিধানসভা কেন্দ্রে নির্দল প্রার্থী হিসাবে জনৈক ইমরান খানের মনোনয়ন জমা দেওয়ার কাহিনি সংবাদ শিরোনামে উঠে এসেছে।কারণ, একেবারে অভিনব আঙ্গিকে তিনি মনোনয়ন জমা দিয়েছেন। গলায় টমেটো ও পেঁয়াজের মাল্য বেষ্টন করে,গর্দভের পৃষ্ঠে চড়ে ইমরান গেছেন মনোনয়ন জমা দিতে।পথচারীদের অনেকে ওই দৃশ্য দেখে প্রকাশ্যে উপহাস করলেও তিনি ছিলেন ভ্রুক্ষেপহীন।এমন কিম্ভূত অবতারে কেন, সাংবাদিকদের প্রশ্নের তিনি যা বলেছেন, অধুনা ভারতীয় সংসদীয় গণতন্ত্রের চালচিত্রে তা অত্যন্ত ইঙ্গিতবাহী। ইমরানের বক্তব্য ছিল, বর্তমান সময়ের জনপ্রতিনিধিদের সম্পর্কে মানুষের যে হতাশাজনিত পরিহাস, প্রতীকী মনোনয়ন যাত্রার মধ্য দিয়ে তিনি সেকথাই বোঝাতে চেয়েছেনইমরান খান কি খুব ভুল কিছু বলেছেন? আমাদের পাশের বাঙালি রাজ্য, নানা কারণে যে রাজ্যটির সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ নিবিড়, সেখানে দুর্নীতির কারণে শাসকদলের দুই মন্ত্ৰী সহযোগে একাধিক বিধায়ক কারাবন্দি হয়েছেন। আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগে এমন একাধিক রাজ্যের একাধিক জনপ্রতিনিধি গ্রেপ্তার হয়েছেন। তাদের মধ্যে তথাকথিত একাধিক উল্লেখযোগ্য মুখও রয়েছেন।এহ বাহ্য, আগে কহ আর।শুধু আর্থিক দুর্নীতি কেন,পাশাপাশি খুন, জখম, ধর্ষণের মতো গুরুতর অভিযোগ নিয়ে বিধানসভা এবং সংসদ ভবনের মতো গণতন্ত্রের পীঠস্থানে, মাথার পিছনে অদৃশ্য জ্যোতির্বলয় নিয়ে দিব্যি বসে আছেন আরও অনেক! গত মাসে একেবারে তথ্য- নথির প্রমাণ সহকারে সেই উদ্বেগ-চিত্র প্রকাশ্যে নিয়ে এসেছে দেশের গণতন্ত্র ও নির্বাচনের হাল-হকিকত নিয়ে কাজ করা দুই সংস্থা অ্যাসোসিয়েশন পর ডেমোক্র্যাটিক রিফর্মস (এডিআর) ও ন্যাশনাল ইলেকশন ওয়াচ (এনইডব্লিউ)। লোকসভা ও রাজ্যসভা মিলিয়ে ৭৬৩ জন সাংসদের ব্যক্তিগত নথি বিশ্লেষণ করে তারা যা দেখেছে, তাকে ‘গণতন্ত্রের কার্যাঙ্কল’ আখ্যা দেওয়াই যায়। ৪০ শতাংশ তথা ৩০৬ জন সাংসদের বিরুদ্ধেই ঝুলছে ফৌজদারি মামলা।১৯৪ জন তথা ২৫ শতাংশের বিরুদ্ধে গুরুতর অপরাধের অভিযোগে মামলা হয়েছে। জামিন-অযোগ্য নানা অপরাধ যেমন খুন, অপহরণ, ধর্ষণ, নারীনিগ্রহ, দুর্নীতি—তালিকা দীর্ঘ।১১ জনের গায়ে লেপ্টে আছে খুনের মামলা, ৩২ জনের বিরুদ্ধে খুনের চেষ্টার অভিযোগ। ধর্ষণের মামলায় ৪ জন এবং নারীদের বিরুদ্ধে অন্য নানাবিধ অপরাধের মামলা চলছে ২১ জন সাংসদের মাথায়।স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে, নির্বাচিত ও মনোনীত জনপ্রতিনিধিরাই যখন অপরাধী বা অভিযুক্ত, তখন দেশের গণতন্ত্র ও শাসনব্যবস্থা নিয়ে গর্ব করার কিছু থাকে কি? মনে রাখা দরকার, উপরের তথ্যগুলি কোনও সমীক্ষা বা অন্য জটিল প্রক্রিয়ায় বার করে আনা নয়, সাংসদদের যে হলফনামা পেশ করতে হয় সেখান থেকেই পাওয়া, অর্থাৎ সাংসদদের স্বঘোষিত।একই সাংসদের বিরুদ্ধে অনেকগুলি, ভারতীয় দণ্ডবিধির একাধিক ধারায় আনা অভিযোগ রয়েছে। যিনি দুর্নীতিতে জড়িয়ে তিনিই আবার অভিযুক্ত অপহরণে! তেলেঙ্গানার এক বিজেপি সাংসদের স্কন্ধে ঝুলছে ৫৫টি গুরুতর অপরাধের মামলা।এ ক্ষেত্রে শাসক-বিরোধীতে বিশেষ তফাত নেই। নারীনিগ্রহের মতো নানা অপরাধে মামলা হয়েছে এমন সাংসদদের মধ্যে রয়েছে বিজেপি কংগ্রেস ওয়াইএসআর কংগ্রেস টিআরএস শিবসেনা সব দলেরই প্রতিনিধি। রাজ্য অনুযায়ী দেখলে নজরে পড়বে, বঙ্গ থেকে নির্বাচিত পাঁচ বিজেপি সাংসদের বিরুদ্ধে আছে নারী সংক্রান্ত অপরাধের অভিযোগ।
তথ্য থেকে যে সত্যটি উঠে আসে, নিহিত শিক্ষার কথাটি সেখানে বলা থাকে না। অথচ সে কথাটিই স্পষ্ট উচ্চারণে বলা দরকার। ভোটে দাঁড়ানোর আগে প্রার্থীরা হলফনামায় যে অপরাধের অভিযোগ বা মামলার তথ্য দিচ্ছেন, তা সাধারণ মানুষের অজানা নয়। তা সত্ত্বেও মানুষ এদের ভোট দিয়ে সংসদে পাঠাচ্ছেন। আর জনসমর্থনে ভর দিয়ে ক্ষমতায় আসা জনপ্রতিনিধিরা ছাড়পত্র পেয়ে যাচ্ছেন অনায়াসে, হয়তো সেই স্পর্ধাতেই নানা অপরাধে জড়াচ্ছেন। ভারতীয় আদালতগুলিতে বিচারের দীর্ঘ সময় ও প্রক্রিয়া, ‘রায়দানের আগে পর্যন্ত অভিযুক্ত অপরাধী নয়’ এই মনোভাবও আখেরে জনপ্রতিনিধিদের আরও মুক্তকচ্ছ করে তুলছে না কি? অতএব, গর্দভের পৃষ্ঠদেশে সওয়ার হয়ে মনোনয়ন পর্বের প্রতীকী যাত্রায় মধ্যপ্রদেশের ওই নির্দল প্রার্থী যদি ভোটারকুলের কাছে সংসদীয় গণতন্ত্র সম্পর্কে কোনও তির্যক বার্তা পৌঁছে দিতে চান, তা কি হবে খুব গর্হিত অপরাধ?