নজরদারি!!

 নজরদারি!!
এই খবর শেয়ার করুন (Share this news)

অনলাইন প্রতিনিধি :-ইজরায়েল থেকে কেনা মোবাইল ফোনে আড়ি পাতার সফ্টওয়ার ‘পেগাসাস’ কাজে লাগিয়ে দেশের বিজেপিবিরোধী বহু বিশিষ্ট নাগরিক,প্রাক্তন বিচারপতি, আইনজীবী থেকে শুরু করে বিরোধী নেতা-নেত্রী, সাংবাদিক,সমাজকর্মীদের ফোনে আড়ি পাতার ঘটনা ঘিরে বছর দুয়েক আগে তোলপাড় হয়েছিল জাতীয় রাজনীতি।

মামলা গড়ায় সুপ্রিম কোর্টে।যদিও সে মামলার এখনও নিষ্পত্তি হয়নি।তার মধ্যেই সামনে এলো অ্যাপলের আইফোনে ‘আড়ি পাতা বিতর্ক।অ্যাপল থেকে আসা বিরোধী নেতা-নেত্রীদের আইফোনের সতর্কবার্তায় লেখা হয়েছে, রাষ্ট্র পরিচালিত হ্যাকারেরা আপনাকে টার্গেট করেছে। অ্যাপল আইফোনটির সঙ্গে আপনার যে আইডি যুক্ত করা আছে,সেটি হ্যাক করার চেষ্টা হচ্ছে।আপনি কে,কী করেন, সম্ভবত এইসব খতিয়ে দেখে হ্যাকাররা নির্দিষ্ট করে আপনাকেই টার্গেট করেছে।’

সতর্কবার্তায় আরও লেখা হয়েছে, ‘রাষ্ট্রপরিচালিত এই হ্যাকারেরা যদি আপনার আইফোনে একবার ঢুকতে পারে, আপনার ব্যক্তিগত তথ্য, কথোপকথন, এমনকী ক্যামেরা এবং মাইক্রোফোনও ওদের হাতে চলে যাবে।তাই দয়া করে এই সতর্কবার্তাকে উপেক্ষা করবেন না।’ উল্লেখ্য, মূলত নিরাপত্তার কারণেই সারা বিশ্বে আইফোনের কদর।কেন্দ্রের তথ্য ও প্রযুক্তিমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণব পাল্টা বলেছেন,অ্যাপলের ওই সতর্কবার্তা শুধু ভারতে নয়, একযোগে অন্তত দেড়শোটি দেশে গেছে।কী কারণে তারা ওই সতর্কবার্তা পাঠিয়েছে,তা জানতে বিশদ তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।এখানে একাধিক প্রশ্ন উঠতে পারে। যেমন বেছে বেছে কেন বিরোধী নেতা-নেত্রীদের ফোনেই এমন বার্তা এলো ? ব্যক্তি পরিসরে নজরদারি তথা আড়ি পাতার বিষয়টি যে সংবিধানপ্রদত্ত দেশবাসীর মৌলিক অধিকারকে চূড়ান্ত খর্ব করে তা নিয়ে কোনও সংশয় নেই।আজকের প্রযুক্তি ব্যবস্থায় কোনও আধুনিক কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্র চাইলে যে কোনও নাগরিকের ব্যক্তি পরিসরে সর্বগ্রাসী, সর্বব্যাপী নজরদারি চালাতে পারে।প্রশ্ন হল, একটি গণতান্ত্রিক দেশে তা কতখানি সঙ্গত এবং অভিপ্রেত।পেগাসাস মামলায় ঠিক দুই বছর আগে সুপ্রিম কোর্টের মাননীয় প্রধান বিচারপতি এন ভি রমণার বেঞ্চ কেন্দ্রের উদ্দেশে মন্তব্য করেছিল,রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার জুজু বা অন্য কোনও অজুহাত দেখিয়ে নাগরিকের জীবনে এমন মাত্রাছাড়া গোপন প্রবেশ চলতে পারে না । তার পরেও যদি, আবার বলছি যে,বাস্তবে এমনটা ঘটে চলে তা জর্জ অরওয়েল-কল্পিত বিকৃত বাস্তব বা ডিস্টোপিয়া তত্ত্বকে মনে করিয়ে দেয়। ওই তত্ত্বে দার্শনিক অরওয়েল দেখিয়েছেন, কীভাবে কর্তৃত্ববাদী একটি রাষ্ট্র সমগ্র দেশকে গ্রাস করতে চায়। এক্ষণে সংবিধান সভায় প্রদত্ত বাবাসাহেব ভীমরাও আম্বেদকরের অতি মূল্যবান ভাষণটি স্মরণীয়।ছত্রে ছত্রে আম্বেদকর সেখানে বলেছিলেন, সংবিধানের পথে শুধু সরকার নয়, সমাজকে পরিচালনা করতে পারলেই আধুনিক ভারত গড়ে উঠবে, যার চাবিকাঠি হল স্বাধীনতা, সাম্য ও বন্ধুত্বের সুদৃঢ় ও সম্মিলিত ভিত্তি।এক নাগরিক এক ভোটের প্রতিশ্রুতিতে মুগ্ধ হয়ে আটকে না থেকে সামাজিক ও আর্থিক বৈষম্য ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে নিরলস সংগ্রাম করার আহ্বান জানিয়েছিলেন শ্রদ্ধেয় আম্বেদকর।রাজনীতিতে অন্ধভক্তি ও ব্যক্তিপূজা কীভাবে গণতন্ত্রের আবরণে একনায়কতন্ত্রকে ডেকে আনে, সে ব্যাপারেও ওই ভাষণে তিনি সদ্যোজাত স্বাধীন গণতন্ত্রের প্রতিটি নাগরিককে সতর্ক করে দিয়েছিলেন।মহাভারতে অভিমন্যু-খ্যাত চক্রব্যূহের মতোই আধুনিক প্রযুক্তিগত -নজরদারি এমন এক চক্র এবং ব্যূহ, যার গ্রাস একবার নাগরিক জীবনে প্রবেশ করলে তদপরবর্তী বহু বর্ম, অস্ত্র, তির, তিরন্দাজ সত্ত্বেও সেই অশুভ বৃত্তের গহ্বর থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হওয়া কার্যত দুরূহ। প্রযুক্তি যেমন মানুষের অশেষ উপকার করে, তেমনই ভয়াবহ বিপন্নতা ওডেকে আনতে পারে।প্রযুক্তির গ্রাস সময়ের স্বাভাবিক ফলাফল হতেই পারে।কিন্তু কোনও সরকার যদি সেই প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে, কুশলী পরিকল্পনায় সেই ব্যূহের গ্রাসে নাগরিককে নিমজ্জিত করতে চা,তার অর্থ সম্পূর্ণ ভিন্ন। বর্তমান শাসক পক্ষ যদি প্রকৃতই এমন ভয়ানক বিপন্নতার মুখে দেশের বিরোধী ভাবাপন্ন নেতাদের নিক্ষেপ করতে চায়, তার বিচার হওয়া অতি আবশ্যক এবং জরুরি। গণতন্ত্রের মানে কী, যদি সেখানে মতামতের বহুত্ব না থাকে? বহুত্বের অর্থ কী, যদি সেখানে প্রতিবাদ না থাকে ? তীব্র গোপন নজরদারির কারণে সেই প্রতিবাদের পথ যদি হয়ে পড়ে, তা বড় সুখের কথা নয়।

Dainik Digital

Dainik Digital

Leave a Reply

Your email address will not be published.