লৌহকপাট!!

 লৌহকপাট!!
এই খবর শেয়ার করুন (Share this news)

অনলাইন প্রতিনিধি :-একবার এক আর্ট এগজিবিশনে একজন একটি ভাঙা সাইকেলকে শিল্পকর্ম হিসেবে দেখিয়েছিলেন।ওই ব্যক্তির বক্তব্য ছিল,শিল্পী যা কিছুকেই শিল্প হিসেবে উপস্থাপন করবে,সেটাই শিল্প কর্ম হিসেবে বিবেচ্য।অবশ্য সে শিল্প কর্ম ভালো হয়েছে না মন্দ,তা বিচারের শ্রেষ্ঠ বিচারক সময়।প্রাইম ভিডিয়োর পর্দায় সম্প্রতি মুক্তি পেয়েছে একাত্তরে ভারত- পাক যুদ্ধাঙ্গনের অন্যতম নায়ক,ভারতীয় ফৌজের ক্যাপ্টেন বলরাম সিং মেহতার আত্মকথন-নির্ভর ছবি ‘পিপ্পা’।এই ছবির সুরকার এ আর রহমান কাজী নজরুল ইসলামের ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ গানটির পঞ্চাশ সেকেণ্ডের ভগ্নাংশের যে নিরীক্ষাজাত পরিবর্তন ঘটিয়েছেন,তা নিয়ে স্বভাবতই বঙ্গজীবনে বিস্তর বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে।রহমান ঠিক করেছেন না ভুল করেছেন, তা নিয়ে ইদানীং কার্যত দ্বিধাবিভক্ত চিন্তাশীল বাঙালি সমাজ।এর সর্বাধিক প্রতিফলন ঘটেছে সামাজিক মাধ্যমে।সেখানে অনেকেই গেল গেল রব তুলেছেন।কবি নজরুল মাত্র বাইশ বছর বয়সে তীব্র আবেগে কারার ঐ লৌহকপাট’ কবিতাটি লেখেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে নিয়ে যাওয়ার প্রতিবাদে।মূলত চিত্তরঞ্জনের স্ত্রী বাসন্তী দেবীর অনুরোধে ১৯২১ সালে নজরুল এই কবিতা লেখেন,যা দেশবন্ধুর সম্পাদনায় ‘বাংলার কথা’ নামে সাপ্তাহিক পত্রিকায় প্রথম ‘ভাঙ্গার গান’ শিরোনামে প্রকাশিত হয় ১৯২২ সালের জানুয়ারী সংখ্যায়। নজরুল নিজের লেখা অধিকাংশ গানের সুরারোপ করে যেতে পারেননি।তবে যে কয়েকটি গানের তা করে গেছেন, তার মধ্যে কারার ঐ লৌহ কপাট’ অন্যতম।কিন্তু এই গান ১৯৪৯ সালে প্রথম যখন রেকর্ডবন্দি হয়, বিদ্রোহী কবি তখন রুদ্ধবাক, অসুস্থ।কবিকে চিকিৎসার জন্য লণ্ডনে নিয়ে যাওয়ার আয়োজন চলছে, তখন এই গান চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন’ ছায়াছবিতে প্রথম ব্যবহার করা হয়।সেই ছবিতে গিরীন চৌধুরীর কণ্ঠে গাওয়া গানে গীতিকার ও সুরকার হিসেবে নজরুলের নামই উল্লিখিত ছিল।গিরীন চৌধুরীর কণ্ঠে ধারণ করা সেই গান বিগ সাড়ে সাত দশক ধরে অগণন বাঙালি শিল্পী গেয়েছেন এবং গেয়ে চলেছেন।এই গান গায়নি বা শোনেনি, এমন বাঙালি বিরল।এই গানকে বাংলাদেশ গণসঙ্গীত হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এই গানের মধ্যে যে দ্রোহ, যে উত্তেজনা, বিদায়ি আর্তনাদ তা দ্রুত লয়ের দাদরা তালে আরও জীবন্ত হয়ে উঠেছে বলে মনে করেন বিদগ্ধমহলের বৃহদংশ। দাদরাকে অনেক সঙ্গীতজ্ঞ পূর্ণাঙ্গ তাল হিসেবে গ্রহণ করেন না, তাই কি রহমান সাহেব বন্দিশের মতো করে নানা যন্ত্রানুষঙ্গে গানটির ভগ্নাংশের পুনর্নির্মাণ করেছেন কি না জানা নেই।রহমানের এই অনুশীলনকে কেউ সৃজনশীল বিশ্বাসঘাতকতা
বলে অভিহিত করতেই পারেন।রহমান আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সুরকার। একজন শিল্পীর যেমন নিজস্ব সৃজন নির্মাণের অথবা পুনর্নির্মাণের স্বাধীনতা আছে, তেমনই শ্রোতাদেরও সমালোচনা করার পূর্ণ স্বাধীনতা রয়েছে।’লৌহকপাট’ গানটিতে যেহেতু কোনও সঙ্গীত স্বত্ত্ব নেই, তাই রহমানের ক্ষেত্রে সাফল্য-বৈফল্য, ন্যায়-অন্যায়ের প্রশ্নটি গৌণ। উদাহরণস্বরূপ,পাণিনী ব্যাকরণের ব্যাখ্যা করেন কাত্যায়ন।পরে আবার কাত্যায়নের ব্যাখ্যা করেন পতঞ্জলি।এক্ষেত্রে প্রথম ব্যাখ্যাটি তখন টেক্সটে রূপান্তরিত হয়।আবার তার ব্যাখ্যাটিকে যখন ব্যাখ্যা করা হয়, তখন দ্বিতীয় ব্যাখ্যাটি টেক্সট।এমনই ভাবে ব্যাখ্যার ব্যাখ্যা,তার তস্য ব্যাখ্যা প্রলয়ের দিন পর্যন্ত চলতে থাকবে।এই চলতে দেওয়াটাই গণতান্ত্রিক পরিসর। যে কোনও কর্মই পূর্বের অগণিত কর্ম থেকে উৎসারিত।তাই যে কোনও সৃজনশীল কর্মই অনন্ত, অগাধ। সমুদ্র অথবা পৃথিবীকে যেমন যেকোনও জায়গা থেকেই দেখা যায়, তেমনই একটি টেক্সটকেও যেকোনও জায়গা থেকে, যে কোনও দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যায়। এই দেখার স্বাধীনতাই গণতন্ত্রের দান।গেল গেল রব তোলা ধর্মধ্বজীদের কাজ, সুস্থ নাগরিক মন সর্বদাই মৌলবাদী কট্টরপন্থার চেয়ে যুক্তিগ্রাহ্যতাকে এগিয়ে রাখতে চায় এবং সেটাই বিধেয়।প্রকৃত গণতন্ত্র সেটাই, যেখানে অহিংস ভাষায় সকলে কথা বলতে পারে এবং সবাই সে কথা শুনতেও পারে। রুশ ভাষাতাত্ত্বিক মিখাইল বাখতিনের চিন্তনবিশ্বের নির্যাসই হল, সকলে কথা বলুক, সবার কথাই শোনা যাক। গণতান্ত্রিক আবহে সবকিছুই নদীর মতো প্রবহমান, বাঁধ দিয়ে আটকে তার উপর খবরদারি চালালে সেটি স্বৈরতন্ত্রের নামান্তর হয়ে যায়।

Dainik Digital

Dainik Digital

Leave a Reply

Your email address will not be published.