দেশ ও রাষ্ট্র!!

 দেশ ও রাষ্ট্র!!
এই খবর শেয়ার করুন (Share this news)

অনলাইন প্রতিনিধি :-ইংরেজি বর্ষবিদায়ের রাতে ফেলে আসা ২০২৩ সাল জুড়ে নিজের তেইশটি মুহূর্তের ছবি প্রকাশ করেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।

তার মধ্যে একটি যেমন ছিল সামরিক উর্দিতে ফাইটার বেশে তেজস যুদ্ধবিমানে উড়া থেকে সংসদ ভবন উদ্বোধনের ছবি।তবে সমাজমাধ্যমে সর্বাধিক সাড়া ফেলেছে,লোককল্যাণ মার্গে প্রধানমন্ত্রীর সরকারী বাসভবনের লনে চারটি অপরূপ সাদা গাভীর সঙ্গে তার ছবি।ছবিটি দেখেই বোঝা যায়, হাত বাড়িয়ে সস্নেহে প্রধানমন্ত্রী তাদের কাছে ডাকছেন।আবার ওইদিনই, বর্ষশেষের রেডিও অনুষ্ঠান ‘মন কি বাত’-এ প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের মূল সুরটি ছিল অযোধ্যায় রামমন্দির ঘিরে গোটা দেশে উত্তেজনা ও আগ্রহ।একে ‘ঐতিহাসিক মুহূর্ত’ আখ্যা দিয়ে দেশবাসীর প্রতি তার আহ্বান ছিল, ‘শ্রীরামভজন হ্যাশট্যাগে এই সংক্রান্ত নিজ শিল্পসৃজন সমাজমাধ্যমে ভাগ করে নিন’।নতুন বছরটি কেমন যাবে, উপরের দুটি পরিপূরক ঘটনা তার দিকনির্দেশ হতেই পারে। প্রকৃত প্রস্তাবে,আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের চালচিত্রে ভারতের কাছে যুগান্তকারী হয়ে উঠতে পারে নিয়ে এই বছর।উত্তম কি অধম,সেটি তর্কসাপেক্ষ হলেও সত্য এই যে, স্বাধীনতার পর সাড়ে ছয় দশক ধরে ভারতের যে সত্তা বিকশিত হয়েছিল,তা পরিবর্তিত হয়ে এখন দ্রুতবেগে এক ভিন্ন রূপ পরিগ্রহণে উদগ্র এই দেশ। ধরে নেওয়া যেতে পারে যে, এই বছরের প্রথম ভাগে অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় নির্বাচন সেই পরিবর্তিত সত্তায় এমনভাবে আনুষ্ঠানিক সিলমোহর বসাবে যা আর সহজে সরানো বা ফেরানো যাবে না।ভারতের সেই নতুন সত্তায় তখন ‘গণতন্ত্র’, ‘ধর্মনিরপেক্ষ’, ‘সমাজতন্ত্র’-এর মতো সর্বজনপঠিত শব্দগুলি কি আদৌ থাকবে,নাকি থাকলেও মৃতবৎ হয়ে পড়বে হলফ করে বলা মুশকিল !তবে দেশ ও দেশভক্তির বদলে রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রবাদের ভজনার সুর অধিক চড়া হলে তা প্রকৃত দেশকল্যাণের দ্যোতক কি না,সে প্রশ্ন উঠতে পারে।রাষ্ট্রবাদের বন্দনা তখনই সুন্দর ও পূর্ণ হয়ে উঠে যখন তার মধ্যে দেশ নামক বিষয়টি অঙ্গাঙ্গী জড়িয়ে থাকে।বৃহদর্থে দেশ কথার অর্থ দায়। প্রতিবেশীকে আগলে রাখার দায় মনে ভিন্ন সুর থাকলেও সমষ্টিবদ্ধ থাকার দায়।দেশভক্তি থাকে আর্ত দেশবাসীর প্রতি দায়িত্ব কর্তব্য সহমর্মিতা আসে অন্তর থেকে এ পর্যন্ত পড়ে কেউ বলতেই পারে, দেশভক্তি কি নেই? এই যে এ এত মানুষ স্বাধীনতার অমৃত মহোৎসবে যোগ দিলেন,সেটা কী কিঞ্চিৎ গভীরে ভাবলে দেখা যাবে, এই পূজায় দেশ কম,বরং রাষ্ট্রে আহ্বানে জাতীয়তার চিৎকৃত উদযাপন বেশি। ‘দেশ’, রাষ্ট্রের চেয়ে বেশি প্রাচীন।তাই দেশপ্রেমের ধারণাও জাতীয়তাবাদের ধারণা চেয়ে অনেক বেশি প্রাচীন।দেশের মধ্যে ‘অপর’ নির্মাণের প্রচেষ্ট নেই, আছে একাত্মতা, ভ্রাতৃত্বের ধারণা।দেশ শুধু কাঁটাতারে ঘেরা এক ভৌগোলিক ভূখণ্ড নয়।দেশ মানে দেশের প্রতিটি মানুষ, প্রতিটি সমাজ।কেউ কারও চেয়ে বড় নয়, ছোট নয়। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের চালিকাশক্তিই ছিল দেশের প্রতি ভক্তি। সমাজতাত্ত্বিক আশিস নন্দী লিখেছিলেন, ‘ওল্ড ফ্যাশন পেট্রিয়টিজম নিয়ে দীর্ঘকাল সুস্থির সমাজজীবন যাপন করছিল ভারত।এই দেশভক্তি প্রতিবেশীর দিকে সন্দিহান হয়ে তাকাতে নয়, সহমর্মী হতে শেখায়।অতীতের সব ক্ষয়ক্ষতির হিসাব বুঝে নিতে নয়, নিজেকে উজাড় করে দিতে শেখায়।ভিন্নতাকে স্বীকার করে নিয়েও তাকে নিজের একটা অংশ হিসেবে দেখা সহজ নয়। যে ধারণা এই কাজটাকে সহজ করতে পারে, তাই হলো ‘দেশ’।দেশ একটি সমষ্টিবদ্ধ ধারণা।স্বাধীনতা এক সমষ্টিগত অর্জন।এই কথা মনে রেখে, চার পাশের আর্ত মানুষের সামান্যতম ক্লেশও দূর করার চেষ্টা না করে, জাত, ধর্ম, বর্ণ ইত্যাদি খণ্ডিত এককে বিভিন্ন ধরনের অপর তৈরি করে ভেদাভেদ ও বিদ্বেষে মেতে উঠলে তখন রাষ্ট্রবাদ রূপকার্থে সোনার পাথরবাটি হয়ে পড়ে।বঙ্কিমচন্দ্রের কমলাকান্ত সপ্তমী পূজার দিন দুর্গা প্রতিমার মধ্যেই জননীকে প্রত্যক্ষ করেছিল। কমলাকান্তের সেই মাতৃমূর্তি ছিল অসংখ্যসন্তানকুল পালিকা’।সবুজ বসনের এই দেবীই দেশ, যিনি সন্তান পালনে ব্রতী।অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ভারতমাতা’ দেখতে দেখতেও এই ভাবটিই জাগ্রত হয়। ভিন্নতাকে স্বীকার করেও তাকে আপন করে নিতে না পারলে, এত আবেগ ও উত্তেজনার মধ্যেও রামমন্দিরের উদ্বোধনও কি অর্থহীন হয়ে পড়ে না ?

Dainik Digital

Dainik Digital

Leave a Reply

Your email address will not be published.