পিত্রোদা ও পারসেপশন!!

 পিত্রোদা ও পারসেপশন!!
এই খবর শেয়ার করুন (Share this news)

ইংরেজিতে চালু একটি প্রবাদ আছে।দেয়ার ইজ স্মোক, দেয়ার ইজ ফায়ার।তবে রাজনীতির অঙ্গনের কোনও স্থল ধূমায়িত হলেই যে তার অর্থ নেপথ্যে অগ্নির অস্তিত্ব রয়েছে,তা নয়।বিস্তর ব্যতিক্রম হয়।তার কারণ রাজনীতিতে ‘মিথ্যা’ এবং ‘বিভ্রম’ শব্দদুটি বড় পরিসর দখল করে রাখে।এই দুই বিষয়ের আবর্তে পড়ে জনতা জনার্দনের মগজে অনেক কিছু ঘুরপাক খায়।এটিই হলো ‘পারসেপশন’।বাংলায় প্রতিশব্দ হতে পারে ইন্দ্রিয়জাত ধারণা।এই বস্তুটি রাজনৈতিক প্রচারে একবার বড় আকার পেয়ে গেলে, অর্থাৎ মানুষের ধারণায় প্রোথিত হয়ে গেলে অনেকসময় তা সত্যাসত্যকে সহজেই টপকে যেতে পারে। এই পারসেপশনের দৌলতেই ১৯৮৯ সালের নির্বাচনে রাজীব গান্ধীকে ‘বফর্সের চোর’ অপবাদ নিয়ে পরাজয়ের গ্লানি হজম করতে হয়েছিল সেটাই ছিল জনতার পারসেপশন। অথচ বফর্স-এ রাজীবের দুর্নীতি প্রমাণ করা যায়নি।
পাঁচ বছর আগের লোকসভা নির্বাচনে রাজীব-তনয় রাহুল গান্ধী রাফাল ইস্যুতে বাজার গরম করতে প্রাণপাত করেছিলেন।স্লোগান তুলেছিলেন ‘চৌকিদার চোর হ্যায়’।কিন্তু সেই স্লোগান জনতার পঞ্চেন্দ্রিয়ে ঘা দিতে পারেনি।উল্টে পুলওয়ামাতে সিআরপির বাসের কনভয়ে বহিঃশত্রুর মদতে সন্ত্রাসবাদীদের ঘটানো বিস্ফোরণ এবং বালাকোটে তার প্রত্যাঘাতের ঘটনার দৌলতে নরেন্দ্র মোদি দেশবাসীর মধ্যে তীব্র জাতীয়তাবোধ জাগিয়ে তুলতে সক্ষম হন।বিজেপি একাই পায় ৩০৩টি আসন।
বিরোধী শিবিরের, বিশেষত প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস নেতৃত্বের অবিবেচক মন্তব্য যে নরেন্দ্র মোদিকে কীভাবে পাল্টা ‘পারসেপশন’ তৈরিতে সাহায্য করেছে, তার প্রথম দৃষ্টান্ত ২০০৭ সালের গুজরাট বিধানসভার নির্বাচন। গুজরাটে জাতি হিংসার প্রসঙ্গে কংগ্রেস নেত্রী সোনিয়া গান্ধী মোদিকে উদ্দেশ্য করে বলে ফেলেছিলেন ‘মওত কা সওদাগর’।ওই একটি ‘ফুলটস’ পেয়ে মোদি মাঠের বাইরে বল পাঠিয়ে দেন। এরপর ২০১৮ সালের গুজরাট বিধানসভা ভোট চলাকালে সুরাটের জনসভায় সরাসরি মোদিকে আক্রমণ করে তদানীন্তন কংগ্রেস নেতা মণিশঙ্কর আইয়ার বেমক্কা বলে বসেন, ‘উও নিচ কিসিম কা আদমি… কোই সভ্যতা নেহি হ্যায়।’ওই এক বক্তব্যকেই বাকি প্রচারে কার্যত পাশুপতের মতো ব্যবহার করে ফের বাজিমাত করেন মোদি।এই লোকসভায় কংগ্রেসের ঘরোয়া নেতারা ‘সমঝে’ খেললেও বেফাঁস মন্তব্য করে কংগ্রেসকে বিপাকে ফেলে দিয়েছেন গান্ধী পরিবারের বহু বছরের ‘ঘনিষ্ঠ’, রাজীব গান্ধীর বন্ধু বলে কথিত স্যাম পিত্রোদা। সৌজন্যে উপর্যুপরি তার দুটি বেফাঁস বয়ান।পিত্রোদা বুধবার সকাল পর্যন্ত ছিলেন কংগ্রেসের ওভারসিজ সভাপতি।আমেরিকায়
বিদেশি সংবাদমাধ্যমের কাছে ভারতের বৈচিত্র তুলে ধরতে গিয়ে বেচারা পিত্রোদা বোঝাতে চেয়েছিলেন ভারত বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্যের দেশ। কিন্তু ভারতীয়দের ‘গাত্রবর্ণ’ নিয়ে এমন মন্তব্য করে বসেন তিনি,যাতে ফল হয়েছে হিতে বিপরীত!পিত্রোদার বিরুদ্ধে বর্ণবিদ্বেষী মন্তব্যের অভিযোগে সরব হয়েছেন মোদি।বিতর্কের জেরে পিত্রোদাকে পদ থেকে সরাতে বাধ্য হয়েছে কংগ্রেস।এমন সুবর্ণ সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে তিলার্ধ সময় অপচয় করেননি মোদি।তিনি তো বটেই, মাঠে নেমে পড়েছেন হিমন্ত বিশ্বশর্মা, কিরণ রিজিজুর মতো পূর্বোত্তরের দুই প্রথম সারির বিজেপি নেতা।বুধবার তেলেঙ্গানার
ওরাঙ্গলের এক জনসভায় মোদি বলেন,’পিত্রোদার ওই মন্তব্যে আমি ভীষণ ক্রুদ্ধ। আমাকে যত ইচ্ছে অপমান করো, সহ্য করব।কিন্তু দেশবাসীর অপমান কোনওভাবেই মেনে নেব না। তিনি বলেন, কৃষ্ণের গায়ের রং যাই হোক না কেন আমরা তাকে পুজো করি।ওই নিন্দনীয় মন্তব্যের জন্য রাহুল গান্ধীকেই জবাব দিতে হবে। মোদি টেনে এনেছেন, গাত্রবর্ণের কারণেই কংগ্রেস মনে করেছিল দ্রৌপদী মুর্মু
আফ্রিকার লোক।যেহেতু তার রং কালো তাই তাকে পরাজিত করতে উঠেপড়ে লেগেছিল কংগ্রেস।এক পক্ষকাল আগে এই পিত্রোদাই আমেরিকার ধাঁচে উত্তরাধিকার কর চাপানোর পক্ষে সওয়াল করে কংগ্রেসকে বেজায় বিড়ম্বনায় ফেলে দিয়েছিলেন।যাকে প্রচারের হাতিয়ার করে মোদি সরাসরি রাহুল তথা কংগ্রেসকে আক্রমণ শানিয়ে
বলেছিলেন, কংগ্রেসের নজর এবার দেশবাসীর সম্পদের উপরে পড়েছে। মা-বোনেদের মঙ্গলসূত্র (মহিষ পর্যন্ত) ছিনিয়ে নেওয়ার ফিকির করেছেন রাহুলরা।
পিত্রোদা কি সত্যিই ভারতীয়দের গাত্রবর্ণ নিয়ে বর্ণবিদ্বেষী কোনও মন্তব্য করেছেন?হয়তো অনেকেই বলবেন, করেননি। কিন্তু তাতে কি? ভুল সময়ে মুখনিঃসৃত অনেক শব্দব্রহ্মই রাজনীতির বাঁক বদলে দেয়।সেখান থেকেই জনমনে তৈরি হয় ‘পারসেপশন’। কংগ্রেসবিরোধী ধারণা তৈরি করতে পিত্রোদার ‘অবদান’ কতটা, তা অবশ্য সময় বলবে।

Dainik Digital

Dainik Digital

Leave a Reply

Your email address will not be published.