মোদি’হীন মোদি!!

 মোদি’হীন মোদি!!
এই খবর শেয়ার করুন (Share this news)

সংখ্যা মানুষকে কি অসংযর্মী করে তোলে? আবার এই সংখ্যাই কি মানুষকে বিনয়ী করে দেয়! গত ১০ বছরে দেশবাসী প্রপ্রধানমন্ত্রী পদে নরেন্দ্র মোদিকে যে রকমটা দেখে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলেন। গত দুই-তিন দিনে সেই পরিচিত চেহারাটাই কেমন যেন উধাও হয়ে গেছে। চেহারা বলতে শুধু বাহ্যিক প্রকাশে নয়। আচরণে, ভূমিকায়, বক্তব্যে সবকিছুতেই যেন অচেনা এক মোদি সামনে এসে ধরা দিচ্ছেন। শুক্রবার এনডিএ সংসদীয় জোটের বৈঠকে নেতা হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পর নরেন্দ্র মোদি রাষ্ট্রপতি ভবনে যান এবং রাষ্ট্রপতির হাতে ২৯২ জন সাংসদের সমর্থনের তালিকা তুলে দিয়ে আসেন। রবিবার সন্ধ্যায় রাষ্ট্রপতি ভবনের লনে তৃতীয়বারের মতো নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা শপথ নেবে। কিন্তু অষ্টাদশ লোকসভা নির্বাচনের ফল ঘোষণার পর থেকে পরবর্তী প্রতিটি ঘটনাক্রমে যে জিনিসটি বারবার সবার চোখেই ধরা পড়ছে তা হলো প্রথম দুই দফার সর্বশক্তিমান, দাপুটে, দোর্দণ্ডপ্রতাপ নরেন্দ্র মোদিকে আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এনডিএ জোটের সর্বসম্মত নেতা নির্বাচিত হওয়ার পর নরেন্দ্র মোদি যখন বলেন, সরকার চালাতে প্রয়োজন বহুমতের। আর দেশ চালাতে প্রয়োজন সর্বমতের তখন বুঝতে হবে গণতন্ত্রের এটাই হলো মহিমা। এই সেদিনও যিনি ‘আব কি বার ৪০০ পার’ স্লোগান তুলেছিলেন, তিনিই রাতারাতি ভোটের ফল বেরোতেই মহাত্মা গান্ধীর সর্বোদয় ভাবনায় নিজেকে পরিচালিত করতে চাইছেন। মনে রাখতে হবে, গত প্রায় আড়াই মাসের দেশের নির্বাচনি প্রচারপর্বে বিজেপির মুখ ছিলেন শুধু একমাত্র মোদিই। লোকসভার ভোটে তিনি একাই গত ৭৫ দিন ১৮০- র বেশি জনসভা, রোড শো করেছেন। প্রতিটি সভাতেই ‘মোদি সরকার’, ‘মোদি গ্যারান্টির’ বাণী শোনাতেন। প্রচারে দলের পোস্টার, ব্যানার, প্ল্যাকার্ড, ফেস্টুনের সবকিছুতেই দেশজুড়ে জ্বলজ্বল করত শুধু মোদির নাম। শুধু লোকসভার ভোট বলেই কথা নয়। তার দ্বিতীয় জমানার পুরো পাঁচ বছর জুড়েই সরকারে, দলে এমনকী তথাকথিত এনডিএ জোটে একমাত্র তিনিই ছিলেন স্বয়ম্ভু। এভাবেই গোটা দেশেই একটা আলাদা ব্র‍্যান্ড হিসাবে নিজেকে তুলে ধরেছিলেন মোদি। তার ১০ বছরের শাসনের প্রায় পুরোটাই, বিশেষ করে শেষের ৫ বছর সরকার, দল পরিচালনায় তিনি এবং তার একমাত্র সহযোগী ছাড়া আর কারও রাজনৈতিক অস্তিত্ব বাস্তবে প্রতিফলিত হয়নি। দ্বিতীয় জমানায় নামে এনডিএ জোট থাকলেও প্রথম ৪ বছরে জোটের কোন বৈঠক হয়নি। এহেন মোদি আচমকাই যখন ৪ জুনের পর রাতারাতি ভিন্ন মোড়কে আত্মপ্রকাশ করেন, তখন এর মধ্যে বৈসাদৃশ্য বড় বেশি করে চোখে ধরা দেবেই। আসলে এখানেই হল জাদুসংখ্যার কেরামতি। ২৭২ থেকে কমে গিয়ে সংখ্যা যখন ২৪০ হয়ে যায় তখনই ঔদ্ধত্য, আত্মসর্বস্বতা ক্ষয় হয়ে যায়। মোদির ক্ষেত্রেও ঘটেছে সেই একই ঘটনা। দলের সংখ্যাধিক্য হ্রাস পাওয়ার পাশাপাশি বারাণসী কেন্দ্রেও ৫ বছর আগেকার জয়ের ব্যবধান ৪ লাখ ৮০ হাজার থেকে ১ লক্ষ ৫০ হাজারে নেমে যাওয়া কোনভাবেই খাটো করে দেখার বিষয় নয়। অনুরূপভাবে অযোধ্যায় রামমন্দিরের প্রতিষ্ঠাকে দলের অন্যতম ভোট অ্যাজেন্ডা বানানোর পর নির্বাচনে ফৈজাবাস কেন্দ্রেই দলীয় প্রার্থীর বিপর্যয় অবশ্যই মোদি ব্র্যান্ড তথা মোদি গ্যারান্টির জন্য বড়সড় ধাক্কা। পরিসংখ্যান বলছে, লোকসভার নির্বাচনি প্রচারপনে ‘মোদি গ্যারান্টি’ অথবা ‘মোদি সরকার’ এই শব্দবন্ধ প্রধানমন্ত্রী নিজের মুখেই উচ্চারণ করেছেন অন্তত ৪২১ বার। অথচ শুক্রবার পুরাতন সংসদ ভবে এনডিএ জোটের সংসদীয় দলের বৈঠক নেতা নির্বাচিত হওয়ার পর মোট ১ঘন্টা ১২ মিনিটের যে দীর্ঘ বক্তব্য রেখেছেন, একেবারের জন্য ‘মোি শব্দটি অর্থাৎ মোদি সরকার কিংবা ‘মোদি গ্যারান্টি’র কথা তার মুখে উচ্চারি হয়নি। যদিও ভাষণে একবার সরকারের গ্যারান্টির কথা বলেছেন। কিন্তু যেখানে নিজের নামটি উধাও। এর আগেও মোদির ভাষণে জয় শ্রীরামের জয়ধ্বনি শোনা গেছে অহরহ। অথচ ৪ জুনের পর বেশ সতর্কভাবেই। শব্দবন্ধটিও আর মোদির ভাষণে শোনা যাচ্ছে না। বরং জয় শ্রীরাে পরিবর্তে উঠে এসেছে জয় জগন্নাথ। ৪ তারিখ ভোটের ফল প্রকাশের রাতে দিল্লীতে দলীয় কার্যালয়েও মোদির কণ্ঠে এই ‘জয় জগন্নাথ’ আচমকাই সবাইকে হতচকিত করে তুলেছিল। কিংবা শুক্রবার এনডি সংসদীয় বৈঠকে মোদির কণ্ঠে যখন উচ্চারিত হয় ‘বিরোধীরা আমা বিরোধী হতেই পারে, কিন্তু তারা রাষ্ট্রবিরোধী নয়, তারাও চায় দেশের উন্নতি। তাই সকলে মিলে বিরোধীদের নিয়েই সরকার দেশের উন্নতি ঘটাবে’ তখন খুব স্বাভাবিক ভাবেই চক্ষু-কর্ণের বিবাদ ভঞ্জনের মতোই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। দ্রুত বদলে যাওয়া সময়ের এই পটভূমিতে গীতি রবি গুহ মজুমদারের লেখা শচীন দেববর্মণের স্মরণীয় সেই গানটি বা কানে বাজছে- হাসো না হাসো না যে হাসি মধুময় / জানি না জানি না এমনও হয় / তুমি আর নেই সে তুমি….।

Dainik Digital

Dainik Digital

Leave a Reply

Your email address will not be published.