রাহুলের পর্বান্তর!!

 রাহুলের পর্বান্তর!!
এই খবর শেয়ার করুন (Share this news)

হংস যেমন পালক থেকে জল ঝরিয়ে শুষ্ক শরীরে ডাঙায় উঠে ইআসে, আসে, রাহুল গান্ধীর পর্বান্তরটি অনুরূপ। যদি বলা যায় তার এই পর্বান্তরের দৌলতেই দশ বছরের দীর্ঘ বিরতির পর লোকসভা পেলো বিরোধী দলনেতা,অতিশয়োক্তি হবে কি?পাপ্পু থেকে শাহজাদা, ঘমণ্ডীয়া (অহংকারীর হিন্দি প্রতিশব্দ) ইত্যাকার বিবিধ অবশব্দে কিছুদিন আগে পর্যন্ত যারা তাকে নিয়ত বিদ্রূপ করে প্রবোধ লাভ করেছেন, সাংবিধানিক স্বীকৃতির সৌজন্যের আজ তাদের চোখের সামনে দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে এক সারিতে হেঁটে সেই তিনি স্পিকারকে তার আসনে বসিয়ে দিয়ে এলেন।এর পূর্বাহ্নে শিষ্টাচার মেনে নিজে থেকেই করমর্দনের হাত বাড়িয়ে দিলেন প্রধানমন্ত্রীর দিকে। কার সঙ্গে মোদির করমর্দন? এই সেদিন যে মানুষটিকে লোকসভার সদরের বাইরে নিক্ষেপ করা হয়েছিল এবং সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে তিনি ফিরে এলে তীব্র শ্লেষে বলা হয়েছিল,তিনি তো খিড়কি দিয়ে সংসদে ফিরেছেন! কংগ্রেসের ভূতপূর্ব সভাপতি সাম্প্রতিককালে, বিশেষত চার হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে তার ভারত জোড়ো যাত্রার মধ্য দিয়ে স্পষ্টতাই নিজের সঙ্গে অনেকখানি বোঝাপড়া করেছেন,নিজেকে নতুন করে গড়ে তোলার চেষ্টা করে গেছেন নিরন্তর।অদপরবর্তী সময়ে তাই কেউ তাকে আর ‘চপলমতি’ অথবা আর্মচেয়ার পলিটিশিয়ান’ বলে ঠেস দিতে পারেনি।
একজন মানুষের নানা আলাদা সত্তাপরিচয় থাকে, কারও পক্ষে এক ও অদ্বিতীয় আত্মপরিচয় ঘোষণা করা স্বাভাবিক নয়, নিরাপদও নয়।এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে স্থান পেয়েছে নানা গোষ্ঠী, গড়ে তুলেছে এক বিচিত্র সভ্যতা, যার মন্ত্রী ‘মিলাবে মিলিবে’, নিজের কল্পিত ভালবাসার দোকানের স্বরূপটি বোঝাতে গিয়ে বস্তুত প্রচারে এই কথাগুলি বলেছিলেন রাহুল। বিভাজনের উগ্র ভাষ্যের বিপ্রতীপে দাঁড়িয়ে রাজনীতির নিজস্ব ভাষা ও ভঙ্গি নির্মাণ করেছেন তিনি।প্রতিস্পর্ধী সে ভাষ্য নির্মাণের প্রথম শর্ত ছিল সংযম,যা তিনি রাজনীতির রুক্ষ পৃষ্ঠভূমিতে ঠোক্কর খেতে খেতে রপ্ত করেছেন।প্রকৃত ভারতের বিপুল জনগোষ্ঠী এখনও গ্রামে বাস করে।তাই এবারের নির্বাচনের রাহুলের মেঠো রাজনীতি গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে সমাদৃত হয়। একদা ইন্দিরা গান্ধীকে দেখা গেছিল বিহারে বন্যা পরিস্থিতি দেখতে গিয়ে বেলচি গ্রামে তার গাড়ির চাকা কাদায় বলে গেলে,গাড়ি থেকে নেমে হাদির পিঠে চড়ে তিনি অকুস্থলে পৌঁছেছিলেন।কিন্তু রাহুলের মেঠো রাজনীতি তার ঠাকুমমার মতো নয়,বরং স্বকীয়। তার সেই স্বকীয় ঘরানা ঘিরেই দেশের একাংশ মানুষ ফের পালাবদলের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলেন।সেই জায়গা থেকেই বাহান্নর কংগ্রেসকে তিনি আজ পৌঁছে দিয়েছেন শতকের দৌরগোড়ায়।ফল প্রকাশের উত্তর-পূর্বে বিরোধী শিবিরের সর্বমহল থেকে সমীহ আদায় করে, বিরোধী নেতার পদ গ্রহণ করে দায়িত্বশীল রাজনীতিকের পরিচয় দিয়েছেন।লোকসভায় প্রধানমন্ত্রীর বিপরীতে মুখোমুখি আসনে বসে তিনি বুঝিয়ে দিচ্ছেন,মোদির প্রকৃত চ্যালেঞ্জার কে!সাদা টি-শার্ট ছেড়ে ভারতীয় রাজনীতির অঘোষিত সর্বজনীন উর্দি ধোপদুরন্ত সাদা পাঞ্জাবি-পায়জামায় আবির্ভূত, যেন নবকলেবরে রাহুল গান্ধী।
বিরোধী নেতা হিসাবে এবার থেকে রাহুল পাবেন কেন্দ্রের পূর্ণমন্ত্রীর পদমর্যাদা। পূর্ণমন্ত্রীর সমতুল্য বেতন, বাসস্থান, নিরাপত্তা ও অন্যান্য সুবিধা।লোকসভার সব বিরোধী দলের নেতৃত্বই তিনি শুধু দেবেন না, তিনি নির্বাচন কমিশনার,সিবিআইয়ের পরিচালক,কেন্দ্রীয় ভিজিল্যান্স কমিশন, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের মতো সাংবিধানিক পদের চেয়ারপার্সন নিয়োগ কমিটির তিনি হবেন অন্যতম সদস্য। তার মতামতকে গুরুত্ব দিতে হবে।এর সার্বিক অর্থ, এতকাল ধরে মোদি ও তার সতীর্থরা যাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে এসেছেন, সেই রাহুলের ওজর আপত্তি যুক্তিকে গুরুত্ব দিতে হবে।বিরোধীরা নির্বাচিত করলে তিনিই হবেন পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটির চেয়ারম্যান।সেটা হলে যাবতীয় সরকারী অডিটও তিনি তলব করতে পারবেন। সরকারকে জবাবদিহিতে বাধ্য করতে পারবেন।
তবে আগামী দিনগুলিতে তার বিরুদ্ধে সংযম হারানোর প্রভৃত প্ররোচনা থাকবে,এতে সন্দেহ নেই।তবে সেই প্ররোচনায় সাড়া না দিয়ে নিজের কাজ করে চলাই পরিণত মানসিকতার লক্ষণ। যে ধরনের মন্তব্যের কারণে তিনি বিপাকে পড়েছেন, আদালতে কার্যত তিরস্কৃত হয়েছেন,সেগুলি মানসিক অপরিণতির লক্ষণ ছাড়া আর কিছুই নয়।রাহুলের স্বাভাবিক ভাষা ও বাগুঙ্গিতে অসংযত, ছাতি- চাপড়ানোর উগ্রতার ব্যধি, নেশা বা অভিনয়রীতি কখনওই দেখা যায়নি।কিন্তু ব্যাঙ্গ বা বক্রোক্তির ছলে মাঝে মধ্যেই রাহুল এমন উক্তি করে থাকেন, যা রুচিসম্পন্ন নয়, আত্মমর্যাদার অনুকূলও নয়। শুধু এখানেই তার আত্মশুদ্ধির প্রয়োজন।

Dainik Digital

Dainik Digital

Leave a Reply

Your email address will not be published.