কে দেবে শান্তির বারি!
দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশের পরিস্থিতি যদি বিগত চৌদ্দ মাস নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকে, তবে প্রশাসনিক প্রচেষ্টার সাদিয়ানে নিয়ে প্রশ্ন উঠবেই।’অখণ্ড ভারত’-এর স্বার্থে দেশের প্রতিটি অঞ্চলকে ভীতিমুক্ত থাকার মৌলিক দায়িত্বটি কেন্দ্রের। যেখানে কাশ্মীর নিয়ে তাদের উদ্বেগ অন্তহীন, সেখানে মণিপুর নিয়ে উলটপুরাণ কেন?এ প্রশ্ন যদি তাবৎ বিরোধী শিবিরের হয় এবং সেই শিবিরের সংসদীয় দলনেতা রাহুল গান্ধী যদি এক বছরের মধ্যে তিনবার উপদ্রুত রাজ্যটিতে পা রাখেন, পীড়িত-আর্ত-ভয়ার্ত মানুষগুলির সঙ্গে দুই দণ্ড কথা বলেন,শাসকের কানে তাদের দুর্দশা পৌঁছে দেওয়ার আশ্বাস দেন,তাকে আগুনে ঘৃতাহুতি বলে পাল্টা দোষারোপ করা যায় কি? ‘আমি’ নিশ্চল থাকলে ‘সে’ সচল হলে সেটি উদ্বেগের, এ কেমন উদ্ভট তত্ত্ব?
বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য রক্ষা করা যে কতটা কঠিন,তা আমাদের সর্বদা স্মরণ করিয়ে দেয় রবীন্দ্রনাথের ‘চিত্রাঙ্গদা’-র এই রাজ্য, যেটি আমাদের পড়শি, আমাদের ‘সাত বোন’ পরিবারের সদস্য। স্বাধীনতার পর থেকে মণিপুর যেভাবে ঘন ঘন অশান্ত থেকেছে, পূর্বোত্তরের আর কোনও রাজ্য তেমন থাকেনি। জনসংখ্যার নিরিখে ক্ষুদ্র মণিপুরে জনসংখ্যা কম-বেশি ৩৫ লক্ষের মধ্যে ৩৫টি জনজাতি সম্প্রদায়ের বাস। স্বাধীনতা ও সার্বভৌমিত্বের দাবিতে বিভিন্ন সময়ে এরা হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছে। কংগ্রেস আমলে নাগা-তাজ্জ্বল সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি রিশাং কেইশিং আট ও নয়ের দশক মিলিয়ে দীর্ঘদিন মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন।তিনি প্রকাশ্যে মন্তব্য করেছিলেন, কাশ্মীরের জঙ্গি কার্যকলাপের চেয়েও ভয়াবহ মণিপুরের সন্ত্রাসবাদ।
গত চৌদ্দ মাস ধরে ক্রমাগত আগুনে পুড়েছে মণিপুর, ঘরছাড়া হয়েছেন অন্তত সাতষট্টি হাজার, যার মধ্যে একাংশের আশ্রয় ত্রাণশিবির, বাকিরা অন্য রাজ্যে পালিয়েছেন।প্রাণহানির সরকারী সংখ্যা ২২৯।তৃতীয় দফায় প্রধানমন্ত্রী হিসাবে নরেন্দ্র মোদির শপথের পরদিনই সরসংঘচালক মোহন ভাগবত নতুন সরকারের উদ্দেশে কিছু বার্তা দিয়েছিলেন, যাকে কার্যত প্রধানমন্ত্রীর প্রতি বার্তা হিসাবেই দেখেছিল রাজনৈতিক মহল।সেদিনের বার্তায় মণিপুর প্রসঙ্গে তিনি বলেন, মণিপুরে শান্তি ফেরানোর বিষয়টি সরকারকে এবার গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে।মণিপুরে পরিস্থিতি সামলাতে রাজ্য সরকারের অপদার্থতার পাশাপাশি যে বিষয়টি সমধিক তাৎপর্যের,তা হল মণিপুর নিয়ে প্রধানমন্ত্রী মোদির আশ্চর্য নীরবতা। অবশেষে সেই মোদি মুখ খুললেন রাজ্যসভার সদ্য সমাপ্ত অধিবেশনে।যদিও স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে তার কথায় মণিপুর উঠে আসেনি। বিরোধীদের ক্রমাগত আক্রমণের মুখে তিনি জবাবি ভাষণ দিয়েছেন মাত্র। প্রথমবার মুখ খুলে তিনি মণিপুরের হিংসার জন্য বিরোধীদের কোর্টে বল ঠেলেছেন।জানিয়েছেন, মণিপুর নিয়ে যারা আগুনে ঘৃতাহুতি দিচ্ছেন, মণিপুরই একদিন তাদের প্রত্যাখ্যান করবে। মণিপুর আগামীদিনে কাদের প্রত্যাখ্যান করবে,সে উত্তর দেবে না হয় আগামী দিন। কিন্তু সদ্য প্রকাশিত লোকসভা ভোটের ফলে স্পষ্ট যে, সে রাজ্যে বিজেপি প্রত্যাখ্যাত। রাজ্যের দুটি আসনই এসেছে কংগ্রেসের ঘরে।নির্বাচন উপলক্ষে কাশ্মীর ব্যতিরেকে প্রধানমন্ত্রী দেশের প্রায় প্রতিটি প্রান্তে পৌঁছলেও গত এক বছরে একটি বারের জন্য মণিপুরে পা রাখেননি।শুধুমাত্র ভোটপ্রার্থী হিসাবে নয়, দেশের শাসক হিসাবেও হিংসায় জীর্ণ এই রাজ্যটিতে তিনি অন্তত একটিবার এলে নিশ্চয়ই পরিস্থিতি উন্নত হতো।কিন্তু তেমনটা হয়নি।বরং আগাগোড়া তিনি মুখে কুলুপ এঁটে থেকেছেন।এমতাবস্থায় মণিপুরের আগুনে কারা ঘৃতাহুতি দিচ্ছে, যদি প্রকৃতই কেউ বা কারা দিয়ে থাকে,তা খুঁজে বার করা আশু প্রয়োজন।কিন্তু যারা নীরব, নিশ্চেষ্ট থেকে সেই আগুনকে বৎসরাধিক কাল জ্বালিয়ে রেখেছেন, তাদের ভূমিকাটিও কী সমভাবে প্রকাশ্যে আসা জরুরি নয়?
রাজ্যসভায় প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতায় উল্লেখ করেছেন, কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার মিলে মণিপুরে পরিস্থিতি শোধরানোর নিরন্তর চেষ্টা করছে।মণিপুরের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের ইতিহাস সর্বজনবিদিত।কিন্তু তার পাশাপাশি অর্থনৈতিক সুযোগ ও সামাজিক সুরক্ষার দাবিগুলিকে কি উপেক্ষা করা যায়?সেই আলোচনায় কতটা সদর্থক থেকেছে মণিপুরের ‘ডবল ইঞ্জিন’ সরকার? শুধুমাত্র গ্রেপ্তারির খতিয়ান দিলে আর বিরোধীদের কাঠগড়ায় তুললেই কোনও রাজ্যের দীর্ঘকালীন সমস্যার মোকাবিলা করা যায় না। রাজ্যের অধিকাংশ নরনারীদের জীবনের অন্ধকার, মোহপাপ, শোকপরিতাপ দূর করতে ক্ষমতার অলিন্দে একে অপরের প্রতি দোষারোপের বদলে যা প্রয়োজন সেটি হলো যথার্থ প্রশাসকোচিত ভূমিকার।তীর্থের কাকের মতো মণিপুর সে দিকেই
চেয়ে আছে।