ধ্বংস যেথায় মনুষ্য-সৃষ্ট!!

 ধ্বংস যেথায় মনুষ্য-সৃষ্ট!!
এই খবর শেয়ার করুন (Share this news)

প্রকৃতির রুদ্ররোষ সর্বদাই যে মনুষ্য-সৃষ্ট তা হয়তো নয়, কিন্তু সাম্প্রতিককালে উত্তরাখণ্ডের কেদারবদ্রী থেকে শুরু করে সিকিম এবং অধুনা কেরলের ওয়েনাডে প্রকৃতিদেবী যে ধ্বংসযজ্ঞ চালালেন,তার নেপথ্যে তিনি যদি দশ ভাগ দায়ী হন,বাকি নবুই শতাংশের দায়ভার অবশ্যই মানুষের।আরও নির্দিষ্ট করে বললে, লোভ, রিরংসা,মুনাফাখোর মানুষের। এ কথা গত দুই মাসের মধ্যে দেশে উপর্যুপরি তিনটি ট্রেন দুর্ঘটনার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য নয় কি?
পশ্চিমবঙ্গ বিগত বাম আমলে একবার ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়েছিল।তদানীন্তন বিরোধী নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেই বন্যাকে ‘ম্যান মেইড’ বলে আখ্যা দিয়েছিলেন।তার সেই বক্তব্যের অভিমুখে নিশ্চয়ই রাজনীতি ছিল, তবে বক্তব্যের সারাৎসারটি অবজ্ঞেয় নয়। সাম্প্রতিক ভারতে অঘটন এবং দুর্ঘটনার মতো শব্দ ক্রমশই যেন গুরুত্ব হারাচ্ছে। ওয়েনাডের প্রাকৃতিক ধ্বংসযজ্ঞে সরকারীভাবে যত মানুষের প্রাণহানি হয়েছে,অগণিত নাগরিকের জীবনকে খাদের কিনারে এনে দাঁড় করিয়েছে, প্রকৃতি ও পরিবেশের অকল্পনীয় ক্ষতি সাধন করেছে, দেশের অনতি-অতীতের পরিসংখ্যানে তা অভূতপূর্ণ।যে ধরনের বিপর্যয়কে কিছুকাল আগেও প্রাকৃতিক দুর্দৈব ছাড়া অন্য কিছু বলে ভাবাই যেত না, এখন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তার নেপথ্যে মানুষের প্রচ্ছন্ন ভূমিকাটি প্রবল।ওয়েনাডের চারটি গ্রাম কার্যত বিলুপ্ত হয়ে গেছে। তার প্রত্যক্ষ কারণ নিঃসন্দেহে একনাগাড়ে অতিবর্ষণ,কিন্তু এই পরিণামকে বহুগুণ ভয়াবহ করে তুলেছে একদিকে পর্যটন এবং অন্যদিকে পাথর, বালি ও অন্যান্য ‘সম্পদ’ খনন,জলবিদ্যুৎ উৎপাদন ও তার সংশ্লিষ্ট যাবতীয় আয়োজনের বল্লাহীন প্রয়াস।ফলে এ নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে, এই বিপর্যয়ে প্রকৃতিদেবীর নির্মম আচরণের ভূমিকা যতখানি, মানুষের চূড়ান্ত লোভ এবং যথেচ্ছাচারের ভূমিকা তার থেকে অনেক,অনেক বেশি।
অথচ বহুদিন ধরেই বিশেষজ্ঞরা বিশদ সমীক্ষা ও গবেষণার ভিত্তিতে বারংবার এই মর্মে সতর্ক করেছেন।অভিভাবকের মতো তারা বলেছেন, ওই অঞ্চলের ভূপ্রকৃতি এমন বিপদ ঘনিয়ে আসতে পারে বলেই এলাকাটিকে সর্বতোভাবে সুরক্ষিত রাখা অত্যন্ত জরুরি। পশ্চিমঘাট পর্বতের সংশ্লিষ্ট এলাকার বাস্তুতন্ত্র তথা প্রকৃতি-পরিবেশের সুরক্ষার উদ্দেশে মাধব গ্যাডগিলের মতো বিশ্ববন্দিত পরিবেশ-বিজ্ঞানীদের নেতৃত্বে গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটি প্রায় এক যুগ আগে এই বিষয়ে অত্যযন্ত মূল্যবান সুপারিশ করেছিলেন। কোথায় কীভাবে পরিবেশের স্বার্থ প্রক্ষা করে উন্নয়নের প্রক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, তার পুঙ্খানুপুঙ্খ পরিকল্পনা তারা সরকার সমীপে পেশ করেছিলেন।সেই মূল্যবান সুপারিশের কত শতাংশ ফলিত স্তরে বাস্তবায়িত হয়েছে, দেবা ন জানন্তি।শুধুমাএ ঈশ্বরের আপন দেশ’ কেরল বলে নয় দেশের,দেশের যেখানেই প্রকৃতি তার অপরূপ শোভা প্রদর্শন করেছে, সেখানেই বিপুল বাণিজ্যের লোভে বহির্বিশ্ব থেকে পর্যটকদের ডেকে আনার ধূম কার্যত অপ্রতিহত।চলছে তথাকথিত উন্নয়নের নামে প্রকৃতির অঙ্গচ্ছেদনের কর্মকাণ্ড। ‘অপরূপ’-এর প্রতি একশ্রেণীর ধুরন্ধর মানুষের লোভে যদি স্বয়ং রাষ্ট্রযন্ত্র লাগাম পরানোর গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বটি পালন না করে, তার চেয়ে আক্ষেপের কিছু হতে পারে না। একশ্রেণীর মানুষকে তাদের লোভ সংবরণে বিরত করা না গেলে আগামী দিনে আমাদের যে আরও ‘ওয়েনাড’ দেখতে হবে, এতে কোনও ভুল নেই।নির্মম হলেও সত্য এই যে, গোটা দেশেই উত্তরোত্তর প্রকট হয়ে চলেছে পরিবেশের প্রতি এই ভয়াল উদাসীনতার সর্বনাশা পরিণাম।ওয়েনাডে ভয়াবহ বিপর্যয়ের পরে কেন এমন ধস নামল, তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন রিসোর্সেস অ্যানালিসিস ডিভিশন অফ দ্য ন্যাশনাল সেন্টার ফর আর্থ সায়েন্সেস (এনসিইএসএস)-এর প্রাক্তন বিজ্ঞানী কে সোমন। তার মতে, এই ধসের নেপথ্যে রয়েছে ভূতাত্ত্বিক কারণ এবং পাহাড়ি জমি ব্যবহারের ধরণ। ইসরোর ন্যাশনাল রিমোট সেন্সিং সেন্টার-এর প্রকাশিত গত বছরের তথ্য অনুযায়ী, দেশের যে ৩০টি সবচেয়ে ধসপ্রবণ এলাকা রয়েছে, তার মধ্যে কেরলে রয়েছে ১০টি। আর দেশের ধসপ্রবণ এলাকার তালিকায় ১৩ নম্বরে ওয়েনাড।২০২২ সালের একটি সমীক্ষা বলছে, ১৯৫০-২০১৮ সালের মধ্যে ওয়েনাডে পাহাড়ি বনভূমি ৬২ শতাংশ উধাও।সেই জায়গায় ১৮০০ শতাংশ বেড়েছে চাষের কাজ। অর্থাৎ, বন কেটে চাষের কাজ করা হচ্ছে রমরমিয়ে।
২০১৩ সালের জুন মাসে উত্তরাখণ্ডের কেদারনাথে অভূতপূর্ব
বিপর্যয়ের সময়েও এই একই কথাগুলি বলা হয়েছিল।সুপারিশ
করা হয়েছিল অস্থির ও স্পর্শকাতর পাহাড়ে নির্মাণকাজ সম্পূর্ণ বন্ধ করার।বলা হয়েছিল, ওই অঞ্চলে পর্যটন, প্রধানত ধর্মাশ্রিত পর্যটন, কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা দরকার।বৃক্ষ তোমার নাম কী,ফলেন পরিচিয়তে! প্রকৃতির পাশাপাশি দেশে ক্রমবর্ধমান রেল দুর্ঘটনা সম্পর্কেও হয়তো একই কথা বিধেয়।এ-সব বিপর্যয় আদতে মনুষ্য সৃষ্টি।

Dainik Digital

Dainik Digital

Leave a Reply

Your email address will not be published.