দ্বিচারিতা!!

 দ্বিচারিতা!!
এই খবর শেয়ার করুন (Share this news)

ক্ষমতায় থাকার একটা দম্ভ ও অহঙ্কার দেশের কম-বেশি সব রাজ্যেই পরিলক্ষিত হচ্ছে।যেহেতু পঞ্চায়েত স্তর থেকে লোকসভা পর্যন্ত বিভিন্ন ক্ষেত্রে একক ও নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকারী ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছে সরকার, তাই সে যা বলবে, যা করবে, সব ঠিক। বাকিরা যে যাই বলুক,সেটি ভুল- এ রকম ভেবে নেওয়াটা স্বাভাবিক নিয়মে পরিণত হয়েছে।টাটকা উদাহরণ কলকাতায় আরজি কর কাণ্ড।নাগরিক সমাজ বিচার চাইছে।আবার বিরোধী দলগুলিও বিচার চেয়েছে। কিন্তু নাগরিক সমাজের চাওয়া, বিভিন্ন বিরোধী রাজনৈতিক দলের বিচার চাওয়া, আবার শাসকদলগুলির বিচারের দাবি- সব কি এক?একা তৃণমূলকে দোষে লাভ নেই, দৈনন্দিন যাপনে মানুষ উপলব্ধি করেছে, ক্ষমতার মুখ আসলে একটাই।ফারাক শুধু মুখোসে।শুধু বঙ্গ কেন, বিজেপি শাসিত রাজ্যেও আকছার এমন ঘটনা ঘটেছে।তার বিচার কতটা মিলেছে, দেশের মানুষ প্রত্যক্ষ করেছে।প্রায় প্রতি ক্ষেত্রেই দেখা গেছে,ঘটনা যা ঘটছে, তার জন্য যে বা যারা দায়ী, তারা কোনও না কোনওভাবে শাসকগোষ্ঠীর ঘনিষ্ঠ।ফলে ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা চলেছে। এমনকী টাকার বিনিময়ে মুখ বন্ধ করাতে চাওয়া, সাক্ষীদের দুর্ঘটনায় আহত, নিহত হওয়ার ঘটনাও অনতি-অতীতে একাধিক ঘটেছে।আসামিদের ধরতে গড়িমসি করা হয়, ধরলেও তারা জামিন পেয়ে যায় সহজেই,তাদের আবার মালা পরিয়ে মিছিল বার করে অভ্যর্থনা জানানো হয়। সম্প্রতি বেনারসে,তার আগে গুজরাটে এমন দৃশ্যপট আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। আদতে এই দ্বিচারিতা ভারতীয় গণতন্ত্রের এক গভীর অসুখ।শাসক ভুলে যায় যে,গণতন্ত্র একটি রাষ্ট্রব্যবস্থার অচলায়তন নয়, এ হচ্ছে এক নিরন্তর সংগ্রামের মুক্তধারা। স্বাধীনতার সঙ্গে ‘সার্বভৌমত্ব’র ধারণাটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত,কিন্তু আমাদের কাছে সার্বভৌমত্বের বহিরঙ্গের চেহারাটিই শুধু ধরা পড়ে। অন্তরঙ্গ থেকে যায় অন্তরালে।যে সার্বভৌমত্বের ধারণার সঙ্গে আমরা প্রতিদিনের জীবনে পরিচিত, তা রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব।কিন্তু সার্বভৌমত্বের সদর ও অন্দরের চাল ও চলন আসলে ভিন্ন।রাষ্ট্রের জন্ম বৃত্তান্তের সঙ্গেও জড়িয়ে রয়েছে সার্বভৌমত্বের বিভিন্ন ধারণার গভীর সংযোগ। একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রে আদর্শ অবস্থায় নাগরিক হবেন সার্বভৌম।নাগরিকরা তাদের অর্জিত ও পুঞ্জিভূত সার্বভৌমত্বের সামান্য অংশ রাষ্ট্রকে দান করেছেন বলেই তো রাষ্ট্র নামের প্রতিষ্ঠানটির জন্ম হয়েছিল!রাষ্ট্র নাগরিকদের জন্ম দেয়নি, নাগরিকরাই রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছেন ক্ষমতা হাতে পেলেই প্রায় সব শাসক এই ধ্রুব সত্যটি থেকে বিস্মৃত হয়। ভুলে যায় যে, রাষ্ট্র নাগরিক বাছাই করতে পারে না, নাগরিক তার রাষ্ট্র বাছাই করবে।
বিরোধিতার ময়দান থেকে যুদ্ধ করে শাসকের কুর্সিতে অধিষ্ঠিত হলে রাজনীতিক এবং দলগুলির চেতনায় যে আসমান জমিন ফারাক তৈরি হয়, বেশি দূরে যাওয়ার নেই, তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে তার একটি উদাহরণ হিসাবে ধরা যেতে পারে।বঙ্গে বাম শাসনের এক দশক পেরিয়ে নবুইয়ের দশকের গোড়ায় দোর্দণ্ডপ্রতাপ জ্যোতি বসু সরকারের চোখে চোখ রেখে কথা বলার সাহস হারিয়েছে এমনকী তৎকালীন প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসও, সে সময় তদানীন্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ‘একা কুম্ভ’ হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। নবুইয়ের দশকে সে রাজ্যে যখন একের পর এক নারী নির্যাতন ও ধর্ষণ-খুনের ঘটনা ঘটছে, সেই আবহে এক মূক-বধির ধর্ষিতা বালিকাকে নিয়ে জ্যোতি বসু সরকারের কাছে বিচার চাইতে মহাকরণে গেছিলেন মমতা। সেদিন জ্যোতিবাবুর পুলিশ তার চুলের মুঠি ধরে বার করে দিয়েছিল।কংগ্রেসকে বামেদের ‘বি টিম’ আখ্যা দিয়ে দলত্যাগ, তৃণমূল কংগ্রেস গঠন, বিধানসভা ভাঙচুর, সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামে আপসহীন জমি আন্দোলন বাম জমানার অন্যায়, অবিচার ও অরাজকতার বিরুদ্ধে মমতা হয়ে উঠলেন প্রতিবাদের সমার্থক শব্দ। সেই নেত্রী ক্ষমতায় থিতু হওয়ার পর সিন্ডিকেট-দালালরাজ-কাটমানি -মহিলা নির্যাতন ও গুণ্ডারাজ-স্বজনপোষণ-ছাপ্পা-রিগিং-ঔদ্ধত্য – তৃণমূল ক্রমে কার্যত বামফ্রন্টকেও টেক্কা দিয়েছে।একই মানুষ, একই নেত্রী কাঠুয়া-উন্নাও- হাঁথরস-মণিপুর নিয়ে অতিমাত্রায় সরব, অথচ নিজ রাজ্যে নারী নির্যাতন ও ধর্ষণ-খুনের গুরুতর বিষয়গুলি তিনি অন্তরালে রেখে দিতে চান।এ কি দ্বিচারিতা নয়?
শাসকের দ্বিচারণের উদাহরণ প্রসঙ্গে ঘটনাচক্রে মমতা এলেন বটে, তবে এমন উদাহরণের অভাব নেই। ধর্মের কল বাতাসে নড়ে যেমন, তেমনই অধর্মের কলও বাতাসে নড়ে। মিথ্যাচার, চালাকি দিয়ে শাসনতন্ত্র চালানো সাংঘাতিক দ্বিচারিতা।শাক দিয়ে মাছ ঢাকার প্রক্রিয়া দিয়ে ভোট নামক মচ্ছব পার করা যায়, কিন্তু গণরোষ-আন্দোলন স্বত:স্ফূর্তভাবে বেরিয়ে আসে, তাকে রোধ করা যায় না।

Dainik Digital

Dainik Digital

Leave a Reply

Your email address will not be published.