পথের নৈতিকতা ও নিরাপত্তা!!

 পথের নৈতিকতা ও নিরাপত্তা!!
এই খবর শেয়ার করুন (Share this news)

দিন দিন পাল্টাইয়া যাইতেছে মানুষের ভাবনাচিন্তার সূত্র। মানুষ আজ রাস্তায় মুমূর্ষু ব্যক্তিকে দেখিলে যত না তাহার ছবি ভিডিও তুলিতে ভালবাসে ততটা তাহাকে বাঁচাইতে চেষ্টা করে না। কেউ হৃদরোগে আক্রান্ত হইয়া রাস্তায় গড়াইলে তৎক্ষনাৎ তাহাকে ধরিয়া হাসপাতালে পাঠাইয়া দেওয়া হইতে পারে পথচারী মানুষের প্রধান কাজ। কিন্তু বাস্তবে এমন ঘটনা আজকাল দেখাই যায় না। যদি কেহ আগাইয়াও আসে, চোখে মুখে জল দিয়া প্রাথমিক শুশ্রুষা দিয়া সুস্থ করার চেষ্টা করেন কিন্তু দেখা যায় সেই ব্যক্তিকে হাসপাতালে লইয়া যাইবার কথা শুনিলে আগরতলার রাজপথে চলাচলকারী কোনও অটো রিকশা বা যানবাহন রাজি হইবে কিনা সন্দেহ রহিয়াছে। সকলের এক ভয়, বিপন্ন মানুষটি যদি পথেই মারা যায় বা হাসপাতালে মারা যায় তাহা হইলে অস্বাভাবিক মৃত্যুর দায়ে তাদের থানা পুলিশ করিতে হইতে পারে। আদালতে ছুটিতে হইতে পারে, যা কাহারো স্বাভাবিক জীবনের অংশ নহে। এই ভয় বা শঙ্কার কারণে অনেক প্রাণ অনর্থক ঝরিয়া যায়, রাস্তায় পড়িয়া। এই ক্ষেত্রে পথ দুর্ঘটনার ঘটনা ঘটিলে তো কথাই নাই। দেখা গেছে, কোনও কোনও পথচারী দুর্ঘটনাগ্রস্ত সহযাত্রীকে হাসপাতালে পাঠাইবার চেষ্টায় রাস্তায় দাঁড়াইয়া চেঁচামেচি, চিৎকার করিয়াও কোনও যানবাহন পাইতেছেন না, সকলেই পাশ কাটাইয়া চলিয়া যাইতেছে। স্বাভাবিক অসুস্থতার তুলনায় দুর্ঘটনার ক্ষেত্রটি অধিক বিপজ্জনক। কেহই পাশে আসিবে না।
সাধারণ্যের এই আশঙ্কা কি সত্য এবং বাস্তব? নাকি সকলই অমূলক? পুলিশ ও দেশের আইন কি এতোটই মানবিকতাবিরুদ্ধ? এই লইয়া আজ বোধ হয় জনসচেতনতামূলক প্রচারের সময় আসিয়াছে আমাদিগের সামনে। মরণাপন্ন সহযাত্রীর জীবন যখন সামান্য চেষ্টা করিলেই বাঁচানো যাইতে পারে তখন সেই চেষ্টাকে মানবিক ও সভ্যতার পক্ষের বলিতে হইবে। সেই চেষ্টা করা যে কোনও মানবিক গুণসম্পন্ন মানুষের সহজাত। কোনও একা পথিকের পক্ষে যদি সম্ভব না হয় তাহা হইলে তার পাশে অন্যদেরও ছুটিয়ে আসিতে হইবে। কিন্তু বাস্তবে তাহা হইতেছে না। ইহা বড়ই পরিতাপের এবং দুশ্চিন্তারও বটে। দুশ্চিন্তা শহরের চরিত্রের, দুশ্চিন্তা নাগরিকদিগের নীতি পরায়ণতা ও মানবিকতার প্রশ্ন। মঠ মসজিদের সাধু, মোল্লার ভাষণ উপদেশ শুনিয়া বিগলিত সমাজ, নেতাদিগের ভাবগম্ভীর এবং সারগর্ভ ভাষণ শুনিতে শুনিতে নিজেদের পণ্ডিত, সবজান্তা ভাবিয়া লওয়া এই সমাজের তথাকথিত সচেতন মানুষের নীতি বিবেক আজ সহস্র প্রশ্নের সম্মুখীন। সম্প্রতি উৎসবের ভিড় বাট্টায় এক অভাবনীয় এবং অনাকাঙিক্ষত এক ঘটনা ঘটিয়া যায় রাজধানীর বুকে, মেলারমাঠ চত্বরে। সন্ধ্যারাত্রে পথঘাট ফুটপাথ যখন মানুষের ভিড়ে ক্লান্ত, পথে পথে উর্দিধারী নিরাপত্তা রক্ষীর টহল চলিতেছে সেই সময়ে এক ব্যক্তি এক দোকানে ঢুকিয়া দোকানিকে টানিয়া হ্যাঁচড়াইয়া বাহিরে আনিয়া একের পর এক ছুরিকাঘাত করিতে থাকে তাহার মৃত্যু নিশ্চি না হওয়া পর্যন্ত। এই ঘটনার সাক্ষী অর্ধশতেক লোক, নিরাপতা রক্ষীরা কেহই হামলাকারীকে আটকাইবার চেষ্টাটুকু করে নাই যতক্ষণ পর্যন্ত না হামলাকারী ক্ষান্ত হইলো। এমনকী লাঠিধারী পুলিশও আটকাইলো না। এক পুলিশ কর্মীকে দেখা গেলে হামলাকারীর পিঠে হাত দিয় অনুরোধের মতন করিয়া তাহাকে নিরস্ত করিবার চেষ্টা করিতেছে। বলিহারি এই নিরাপত্তার। দেখা গেল ওই নিরাপত্তা রক্ষী ত্রিপুরা রাজে সশস্ত্র বলেরই এক কর্মী ছিল। একদা এই বাহিনীর বীরবন্ধুত্ব ত্রিপুরাবাসীকে গর্বিত করিয়া ছিল। আজ আর পাহাড়ে সন্ত্রাসবাদী কাজকর্ম যেমন নাই তেমনি এই বাহিনীর গৌরবও কপূরের ন্যায় মিলাইয়া গিয়াছে। সশস্ত্র এই জওয়ানেরা যারা জীবন মরণ পন করিয়া মাঠে নামিয়া অতি আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত সন্ত্রাসবাদীদের হেলা মেকাবিলা করিত তাহারা এখন লাঠি হাতে দুর্গাপুজোর ভি সামলাইবার কাজ করিয়া থাকে, ব্যস্ত রাজপথে ট্রাফিক কন্ট্রোল করিয়া থাকে। অবশ্য শেষ পর্যন্ত হামলাকারীকে তাহারাই নিরস্ত্র করে আর ময়দানে আসিয়া যায় এক দল বীরপুঙ্গব নাগরিক। এতোক্ষণে যাহার ছুরিকাঘাতের দৃশ্য উপভোগ করিতেছিল এবং সোশ্যাল মিডিয় জীবন্ত হত্যাকান্ডের ভিডিও লাইভ করিতেছিল এক পরম নাগরিক- দায়ে তাহারা এই বার মুহুর্তে সাহস সঞ্চয় করিল এবং পুলিশের হাত হইতে নিরস্ত্র হামলাকারীকে ছিনাইয়া লইয়া সকলে মিলিয়া হাতে মিটাইতে থাকে। ফল যা হইবার তাহাই হইলো, আক্রান্ত দোকানি একদিন পর আর আক্রমণকারী সাত / আট দিন পর হাসপাতালের শয্যায় মারা গেল। একটি অপরাধের ঘটনা চিরতরে অন্ধকারে নিমজ্জিত হইলো আর চলিয়া গেল দুইটি প্রাণ। দিনের শেষে আমরা পাইলাম কেবল একখানি হত্যার ভিডিও। নির্মম এই ভিডিও পুলিশের প্রাথমিক তদন্তে আসিবে বৈ আর কোনও কাজে কি আসিল? আসিল বটে। সমাজে একদল মর্ষকাম মানুষ সেই ভিডিও দেখিয়া আহা উহু করিল, অলস সময় কাটাইলো। কিন্তু এমন নহে যে এই ভিডিও দেখিয়া তাহার কোনও শিক্ষা নিল। সুস্থ সমাজ, সুস্থ ভাবনার নগরে কি হইবার ছিল আর কি ঘটিয়া গেল। হইবার কথা ছিল পথচারীরা দল বাঁধিয়া আক্রমণোম্মুখ হামলাকারীকে নিরস্ত করিল এবং নিরাপত্তাবাহিনী তাহাকে জিম্মায় লইলো। আক্রান্ত ব্যক্তিকে তৎক্ষনাৎ হাসপাতালে পাঠাইয়া দেওয়া গেল। ইহাতে আক্রান্ত ব্যক্তির যেমন বাঁচিবার সুযোগ থাকিত তেমনি আক্রমণকারীকে জিজ্ঞাসাবাদ এবং তদন্ত চালাইয়া রহস্য ভেদ করা যাইতো। দোষি ব্যক্তি সাজা পাইতো, সমাজ আগাইয়া যাইতো সঠিক পথে। কিন্তু তাহা হইলো না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশ অনেক আগেই নিজেদের গরিমা হারাইয়াছে। যে টিএসআর জওয়ানকে লাঠি হাতে রাস্তায় নামানো হইয়াছে তাহারা তো সাধারণ পুলিশের প্রশিক্ষণ নাই, ফলে নির্দেশহীন জওয়ান লাঠি চালাইবে না। ঘাতককে পিঠে হাত দিয়া নিরস্ত করিতে চাহিয়াছে।আইন ও আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থা যখন এমন হাস্যকর পর্যায়ে আসিয়া যায় তখন সমাজ সচেতন ব্যক্তিকে অনিচ্ছায়ও হাসিতে হয়। এই হাসি অত্যন্ত করুণ এবং মর্মন্তুদ। কারণ এই সমাজ এর সমাজবদ্ধ মানুষের নীতিবোধ ও মানবিকতা সকলই যখন হারাইয়া যাইতেছে তখন তো শুধু হারিয়া যাইবারই কাল। সমাজ বাঁচিবে কীমতে।

Dainik Digital

Dainik Digital

Leave a Reply

Your email address will not be published.